Why is Lord Brahma not worshipped in Hinduism: হিন্দুধর্মের ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরকে যথাক্রমে সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের দেবতা হিসেবে গণ্য করা হয়। এই ত্রিদেবের মধ্যে ভগবান বিষ্ণু এবং মহাদেবের পূজা পৃথিবীব্যাপী প্রচলিত হলেও, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার পূজা সেইভাবে প্রচলিত নয়। হাতে গোনা কয়েকটি মন্দির ছাড়া তাঁর উপাসনা প্রায় চোখে পড়ে না। এর পেছনে লুকিয়ে আছে একাধিক পৌরাণিক কাহিনী, অভিশাপ এবং গভীর দার্শনিক তাৎপর্য। মূলত ভগবান শিব এবং ঋষি ভৃগুর দ্বারা প্রদত্ত অভিশাপকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়, যা ব্রহ্মাকে সাধারণের পূজার্চনা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মার উপাসনা না হওয়ার বিষয়টি আকস্মিক নয়। এর শিকড় প্রোথিত রয়েছে সৃষ্টি এবং অহংকারের দ্বন্দ্বে জড়িত পৌরাণিক আখ্যানে। একটি বহুল প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, একবার ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিবাদ শুরু হয়। এই বিবাদের অবসানের জন্য মহাদেব এক বিশাল জ্যোতির্লিঙ্গের রূপে আবির্ভূত হন এবং বলেন যে, যিনি এই লিঙ্গের আদি বা অন্ত খুঁজে বের করতে পারবেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবেন। ব্রহ্মা হংসের রূপ ধরে ঊর্ধ্বে এবং বিষ্ণু বরাহের রূপ ধরে নিম্নে গমন করেন। হাজার হাজার বছর চেষ্টার পরেও বিষ্ণু এর তল খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। অন্যদিকে, ব্রহ্মা উপরে যাওয়ার সময় স্বর্গ থেকে পতিত একটি কেতকী ফুলকে দেখতে পান। তিনি ফুলটিকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি করান যে, তিনি জ্যোতির্লিঙ্গের শীর্ষদেশ দর্শন করেছেন। এই মিথ্যাচারে মহাদেব প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হন এবং ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন যে, তাঁর এই ছলনার কারণে মর্ত্যলোকে কখনোই তাঁর পূজা হবে না। একই সাথে তিনি কেতকী ফুলকেও তাঁর পূজা থেকে চিরকালের জন্য বহিষ্কার করেন, যেমনটি শিব পুরাণ-এ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ঘটনাটি ব্রহ্মার পূজা না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ব্রহ্মার পরিচয়: বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা
হিন্দু ধর্মানুসারে, ব্রহ্মা হলেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্থপতি ও সৃষ্টিকর্তা। তিনি প্রজাপতি নামেও পরিচিত, কারণ সমস্ত প্রজার সৃষ্টি তাঁর দ্বারাই হয়েছে। তাঁর চারটি মস্তক চারটি বেদের (ঋক্, সাম, যজুঃ, অথর্ব) প্রতীক এবং তাঁর চার হাত যথাক্রমে যজ্ঞের পাত্র, বেদের পুঁথি, জপমালা এবং কমণ্ডলু ধারণ করে, যা সৃষ্টি, জ্ঞান এবং ত্যাগের প্রতীক। ব্রহ্মা সাধারণত পদ্মাসনে উপবিষ্ট থাকেন এবং তাঁর বাহন হলো হংস, যা জ্ঞান ও বিচক্ষণতার প্রতীক।
পুরাণ মতে, সৃষ্টির আদিতে যখন কিছুই ছিল না, তখন ভগবান বিষ্ণু অনন্ত শয্যায় যোগনিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। তাঁর নাভিকমল থেকে একটি পদ্ম প্রস্ফুটিত হয় এবং সেই পদ্মের উপর ব্রহ্মার জন্ম হয়। এরপর তিনি বিষ্ণুর নির্দেশে এই চরাচর জগৎ সৃষ্টি করেন। মনু, সপ্তর্ষি এবং অন্যান্য প্রজাপতিদের সৃষ্টি করে তিনি পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার করেন। তাই তাঁকে “স্বয়ম্ভূ” বা নিজে থেকে জাত এবং “পিতামহ” বা সকলের পিতামহ হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
ব্রহ্মার উপাসনা না হওয়ার পেছনের পৌরাণিক কাহিনী
ব্রহ্মার পূজা না হওয়ার কারণ হিসেবে শুধুমাত্র একটি নয়, একাধিক পৌরাণিক আখ্যান এবং অভিশাপের কথা শোনা যায়। প্রতিটি কাহিনীর মধ্যেই লুকিয়ে আছে অহংকার, অন্যায় এবং তার পরিণতির বার্তা।
শিবের অভিশাপ: কেতকী ফুলের মিথ্যা সাক্ষ্য
এই কাহিনীটি সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং ব্যাপকভাবে পরিচিত। পূর্বে উল্লিখিত ঘটনা অনুসারে, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর শ্রেষ্ঠত্বের বিবাদের সময় মহাদেব জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হন। বিষ্ণু নিজের অক্ষমতা স্বীকার করে নিলেও, ব্রহ্মা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লোভে মিথ্যার আশ্রয় নেন। তিনি কেতকী ফুলকে মিথ্যা সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপিত করেন।
এই মিথ্যাচারের তিনটি প্রধান পরিণতি হয়:
- ব্রহ্মার প্রতি অভিশাপ: ক্রুদ্ধ মহাদেব ঘোষণা করেন, “যেহেতু তুমি সৃষ্টির কর্তা হয়েও শ্রেষ্ঠত্বের লোভে এমন ছলনার আশ্রয় নিয়েছ, তাই মর্ত্যলোকে কোনোদিন তোমার পূজা হবে না এবং তোমার নামে কোনো মন্দিরও প্রতিষ্ঠিত হবে না।”
- কেতকী ফুলের নির্বাসন: মহাদেব কেতকী ফুলকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে, এই ফুল আর কোনোদিন শিব পূজায় ব্যবহৃত হবে না। এই কারণেই আজও শিব পূজায় কেতকী ফুল নিষিদ্ধ।
- বিষ্ণুর মহিমা বৃদ্ধি: অন্যদিকে, বিষ্ণুর সততায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে আশীর্বাদ করেন এবং বলেন যে, ব্রহ্মার সমতুল্য হয়েও তিনি পৃথিবীতে সর্বদা পূজিত হবেন এবং তাঁর নামে অসংখ্য মন্দির নির্মিত হবে।
এই ঘটনাটি লিঙ্গ পুরাণ এবং শিব পুরাণে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং এটিই ব্রহ্মার উপাসনা বন্ধ হওয়ার প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়।
ঋষি ভৃগুর অভিশাপ: ব্রহ্মার অহংকার
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাহিনী ঋষি ভৃগুর সঙ্গে জড়িত। পদ্ম পুরাণ অনুসারে, একবার সরস্বতী নদীর তীরে প্রজাপতিরা এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। যজ্ঞের প্রধান দেবতা কে হবেন, তা নিয়ে ঋষিদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। তখন তাঁরা ঋষি ভৃগুর উপর এই দায়িত্ব দেন যে, তিনি ত্রিদেবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সত্ত্বগুণী দেবতাকে নির্বাচন করবেন।
ঋষি ভৃগু প্রথমে ব্রহ্মার নিবাস ব্রহ্মলোকে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন, ব্রহ্মা দেবী সরস্বতীর সঙ্গীতে এতটাই মগ্ন যে তিনি ঋষি ভৃগুর আগমন এবং তাঁর অভিবাদন কোনোটিই খেয়াল করেননি। নিজের এই অবমাননায় ঋষি ভৃগু অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেন এবং ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন, “হে ব্রহ্মা! তুমি সৃষ্টির কর্তা হয়েও রাজসিক অহংকারে এতটাই মগ্ন যে অতিথির সম্মানটুকুও করতে ভুলে গেছ। তাই পৃথিবীতে কেউই তোমার পূজা করবে না।”
এই ঘটনার পর ভৃগু কৈলাসে এবং বৈকুণ্ঠেও যান এবং অবশেষে বিষ্ণুকে শ্রেষ্ঠ সত্ত্বগুণী দেবতা হিসেবে নির্বাচন করেন। ঋষির এই অভিশাপও ব্রহ্মার পূজা না হওয়ার একটি বড় কারণ হিসেবে গণ্য হয়।
শতরূপার প্রতি আসক্তি: নৈতিক পদস্খলন
কিছু পুরাণে, যেমন মৎস্য পুরাণ এবং ব্রহ্মা পুরাণ-এ, একটি বিতর্কিত আখ্যান পাওয়া যায় যা ব্রহ্মার নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং তাঁর উপাসনা হ্রাসের কারণ হিসেবে দেখানো হয়। এই কাহিনী অনুসারে, ব্রহ্মা নিজের সৃষ্টির সৌন্দর্যে নিজেই মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি শতরূপা (যাকে কিছু গ্রন্থে সরস্বতীও বলা হয়েছে) নামে এক সুন্দরী নারীকে সৃষ্টি করেন। শতরূপা ছিলেন ব্রহ্মার মানসকন্যা।
কিন্তু ব্রহ্মা শতরূপার সৌন্দর্যে এতটাই মোহিত হয়ে পড়েন যে তাঁর মধ্যে অনৈতিক কামনার উদ্রেক হয়। শতরূপা ব্রহ্মার এই দৃষ্টি থেকে বাঁচতে বিভিন্ন দিকে পালাতে থাকেন, কিন্তু ব্রহ্মা তাঁকে দেখার জন্য একে একে পাঁচটি মস্তকের সৃষ্টি করেন। তাঁর এই অনৈতিক আচরণে মহাদেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তকটি ছেদন করেন।
পুরাণ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সৃষ্টিকর্তার এই ধরনের অনৈতিক আচরণ তাঁর সম্মান এবং পূজনীয়তা হ্রাস করে। যে দেবতা নিজের সৃষ্টির প্রতিই কামাসক্ত হন, তিনি মর্ত্যলোকে উপাসনার যোগ্যতা হারান। এই ঘটনাটি ব্রহ্মার চরিত্রকে এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত করে, যা তাঁর পূজা না হওয়ার একটি সামাজিক ও নৈতিক কারণ হিসেবে কাজ করে।
দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা
পৌরাণিক কাহিনীর বাইরেও ব্রহ্মার পূজা না হওয়ার পেছনে কিছু গভীর দার্শনিক এবং আধ্যাত্মিক কারণ রয়েছে, যা হিন্দুধর্মের মূল তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত।
সৃষ্টির কাজ সম্পন্ন
হিন্দু দর্শন অনুযায়ী, ব্রহ্মার প্রধান কাজ হলো সৃষ্টি। একবার এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর তাঁর ভূমিকা কার্যত শেষ হয়ে যায়। অন্যদিকে, ভগবান বিষ্ণুর কাজ হলো এই সৃষ্টিকে পালন করা এবং মহাদেবের কাজ হলো পুরনোকে ধ্বংস করে নতুনের জন্য পথ তৈরি করা। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পালনকর্তা বিষ্ণুর আশীর্বাদ এবং সংহারকর্তা শিবের कृपा উভয়ই প্রয়োজন। বিপদ থেকে রক্ষা, সমৃদ্ধি লাভ বা মোক্ষ প্রাপ্তির জন্য ভক্তরা এই দুই দেবতার শরণাপন্ন হন।
যেহেতু ব্রহ্মার সৃষ্টির কাজ সমাপ্ত, তাই তাঁর কাছে প্রার্থনা করার মতো প্রাসঙ্গিক কিছু সাধারণ মানুষের জীবনে থাকে না। তাঁর ভূমিকা অনেকটা একজন স্থপতির মতো, যিনি একটি বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করে চলে গেছেন। এখন সেই অট্টালিকার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অন্যের হাতে। এই কারণেই ব্যবহারিক উপাসনার ক্ষেত্রে ব্রহ্মার গুরুত্ব কমে এসেছে।
রজঃ গুণের প্রতীক
সাংখ্য দর্শন অনুসারে, প্রকৃতি তিনটি গুণে বিভক্ত – সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ।
- সত্ত্বগুণ: জ্ঞান, পবিত্রতা, শান্তি এবং স্থিতিশীলতার প্রতীক। ভগবান বিষ্ণুকে সত্ত্বগুণের আধার বলে মনে করা হয়।
- রজোগুণ: কর্ম, আবেগ, ইচ্ছা এবং আসক্তির প্রতীক। ব্রহ্মাকে রজোগুণের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, কারণ সৃষ্টির জন্য কর্ম এবং ইচ্ছার প্রয়োজন।
- তমোগুণ: অজ্ঞতা, জড়তা, ধ্বংস এবং পরিবর্তনের প্রতীক। মহাদেবকে তমোগুণের ঊর্ধ্বে स्थित transcendental সত্তা হিসেবে গণ্য করা হয়, যিনি ধ্বংসের মাধ্যমেও পবিত্রতা আনয়ন করেন।
হিন্দুধর্মে মোক্ষ বা মুক্তিলাভই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। রজোগুণ মানুষকে কর্ম এবং ফলের বন্ধনে আবদ্ধ করে, যা সংসার চক্র থেকে মুক্তির পথে বাধা সৃষ্টি করে। তাই আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে সাধকরা রজোগুণের প্রভাব থেকে বেরিয়ে সত্ত্বগুণের দিকে অগ্রসর হতে চান। যেহেতু ব্রহ্মা রজোগুণের প্রতীক, তাই মোক্ষকামী ভক্তরা তাঁর উপাসনার পরিবর্তে সত্ত্বগুণী বিষ্ণু বা সংসারচক্রের পারে অবস্থিত মহাদেবের উপাসনাকেই শ্রেয় বলে মনে করেন।
কারণ | পৌরাণিক/দার্শনিক ব্যাখ্যা | সম্পর্কিত পুরাণ/সূত্র |
শিবের অভিশাপ | জ্যোতির্লিঙ্গের শীর্ষ খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে মিথ্যা বলা এবং কেতকী ফুলকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা। | শিব পুরাণ, লিঙ্গ পুরাণ |
ঋষি ভৃগুর অভিশাপ | যজ্ঞের সময় ঋষি ভৃগুর আগমনে তাঁকে অবজ্ঞা করা এবং অহংকার প্রদর্শন। | পদ্ম পুরাণ, ভাগবত পুরাণ |
শতরূপার প্রতি আসক্তি | নিজের মানসকন্যা শতরূপার প্রতি অনৈতিকভাবে আকৃষ্ট হওয়া। | মৎস্য পুরাণ, ব্রহ্মা পুরাণ |
দার্শনিক কারণ | সৃষ্টির কাজ সম্পন্ন হওয়ায় তাঁর ভূমিকা বর্তমানে সীমিত। বিষ্ণু ও শিবের ভূমিকা চলমান। | হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্ব |
আধ্যাত্মিক কারণ | রজোগুণের প্রতীক হওয়ায় মোক্ষ সাধনার পথে তাঁর উপাসনা ততটা সহায়ক বলে মনে করা হয় না। | সাংখ্য দর্শন |
ভারতে ব্রহ্মার মন্দির
অভিশাপ থাকা সত্ত্বেও, ভারতে ব্রহ্মার কয়েকটি মন্দির এখনো বিদ্যমান, যা তাঁর উপাসনার ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হতে দেয়নি।
পুষ্কর: ব্রহ্মার পবিত্র তীর্থ
ব্রহ্মার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রায় একমাত্র প্রধান মন্দিরটি রাজস্থানের পুষ্করে অবস্থিত। পদ্ম পুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মা পৃথিবীতে যজ্ঞ করার জন্য একটি পবিত্র স্থান খুঁজছিলেন। তাঁর হাত থেকে পদ্মফুল যেখানে পড়েছিল, সেখানেই একটি হ্রদের সৃষ্টি হয় এবং সেই স্থানটি পুষ্কর নামে পরিচিতি লাভ করে।
ব্রহ্মা সেখানে এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেন। কিন্তু যজ্ঞের শুভ মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী উপস্থিত হতে পারেননি। যজ্ঞের সময় পেরিয়ে যাওয়ায় ব্রহ্মা স্থানীয় এক কন্যা গায়ত্রীকে বিবাহ করে যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। পরে দেবী সাবিত্রী এসে এই ঘটনা জানতে পেরে ক্রুদ্ধ হন এবং ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন যে, পুষ্কর ছাড়া পৃথিবীতে আর কোথাও তাঁর পূজা হবে না। এই কারণেই পুষ্করের ব্রহ্মা মন্দিরটি এতটা অনন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমায় এখানে বিশাল মেলা বসে এবং হাজার হাজার ভক্ত ব্রহ্মার দর্শনে আসেন।
অন্যান্য মন্দির
পুষ্কর ছাড়াও ভারতের কয়েকটি স্থানে ব্রহ্মার মন্দির দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- আসোত্রা ব্রহ্মা মন্দির, রাজস্থান: এটি রাজস্থানের বাড়মের জেলায় অবস্থিত এবং এখানে ব্রহ্মার সাথে তাঁর স্ত্রী গায়ত্রী ও সাবিত্রীর মূর্তিও রয়েছে।
- কুম্ভকোনম ব্রহ্মা মন্দির, তামিলনাড়ু: তামিলনাড়ুর কুম্ভকোনমে অবস্থিত বেদনারায়ণস্বামী মন্দিরে ব্রহ্মার একটি পৃথক উপাসনাস্থল রয়েছে।
- থিরুনভায়া ব্রহ্মা মন্দির, কেরালা: কেরালার মালাপ্পুরম জেলার এই মন্দিরটিও বেশ প্রাচীন।
এই মন্দিরগুলোর অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, ব্যাপক আকারে না হলেও, নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে ব্রহ্মার উপাসনার ধারা এখনো সীমিত আকারে হলেও টিকে আছে।
সৃষ্টিকর্তা হয়েও ব্রহ্মার পূজা না হওয়ার বিষয়টি হিন্দুধর্মের এক fascinating দিক। এর পেছনে থাকা পৌরাণিক অভিশাপ, নৈতিক স্খলনের কাহিনী এবং গভীর দার্শনিক তত্ত্বগুলো একত্রে এক জটিল চিত্র তৈরি করে। ভগবান শিব এবং ঋষি ভৃগুর অভিশাপ যেখানে তাঁর পূজাকে সীমাবদ্ধ করেছে, সেখানেই তাঁর রজোগুণের প্রতীকী রূপ এবং সৃষ্টির কাজ সম্পন্ন হওয়ার ধারণাটি তাঁকে সাধারণের উপাসনা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তবে পুষ্করের মতো তীর্থস্থান প্রমাণ করে যে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা হিন্দুধর্মের স্মৃতি থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাননি; বরং এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন, যেখানে তাঁর ভূমিকা সৃষ্টিকর্তা হিসেবে স্বীকৃত, কিন্তু উপাসনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। এই পরিস্থিতি হিন্দুধর্মের বহুস্তরীয় এবং প্রতীকী প্রকৃতির এক চমৎকার উদাহরণ।