does mango make you sleepy: গ্রীষ্মকালে রসে টসটসে পাকা আম খাওয়ার পর হঠাৎ করেই চোখে ঘুম নেমে আসে – এমন অভিজ্ঞতা কমবেশি সবারই আছে। আম খেলে ঘুম আসে কেন এই প্রশ্নটি অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়। অনেকে মনে করেন এটি হয়তো গরমের কারণে বা ভরপেট খাবারের ফল। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে ভিন্ন কথা। ফলের রাজা আমের মধ্যে রয়েছে এমন কিছু প্রাকৃতিক উপাদান যা আমাদের শরীরে একটি জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়া শুরু করে, যার শেষ পরিণতি হলো মৃদু তন্দ্রাচ্ছন্নতা। আজকের এই লেখায় আমরা জানবো আম খেলে ঘুম আসার পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণগুলো এবং এর সাথে জড়িত রহস্যময় তথ্যসমূহ।
আমে কী আছে যা ঘুম আনে?
পাকা আমের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ট্রিপটোফ্যান নামক একটি বিশেষ অ্যামাইনো অ্যাসিড। এই ট্রিপটোফ্যানই মূলত আম খেলে ঘুম আসার প্রধান কারণ। ট্রিপটোফ্যান হলো একটি এসেনশিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিড, যা আমাদের শরীর নিজে তৈরি করতে পারে না বলে খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়।
আমে রয়েছে প্রাকৃতিক চিনি ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ, যা খাওয়ার পর শরীরে শর্করার পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যায়। এর ফলে অগ্ন্যাশয় থেকে বেশি পরিমাণে ইনসুলিন নিঃসরিত হয়। আমে থাকা কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, ভিটামিন ও মিনারেল একসাথে মিলে শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে।
এছাড়াও আমে রয়েছে ভিটামিন বি৬ (পাইরিডক্সিন), যা সেরোটোনিন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি আমে দৈনিক ভিটামিন বি৬ এর প্রয়োজনের প্রায় ৮ শতাংশ পূরণ হয়।
ট্রিপটোফ্যান কীভাবে কাজ করে?
ট্রিপটোফ্যান মস্তিষ্কে পৌঁছানোর জন্য রক্ত-মস্তিষ্ক বাধা (ব্লাড-ব্রেইন ব্যারিয়ার) অতিক্রম করতে হয়। এখানেই ইনসুলিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আসে। আম খাওয়ার পর যে ইনসুলিন নিঃসরিত হয়, তা ট্রিপটোফ্যানকে মস্তিষ্কে প্রবেশে সাহায্য করে।
সাধারণত রক্তে বিভিন্ন অ্যামাইনো অ্যাসিড ট্রিপটোফ্যানের সাথে প্রতিযোগিতা করে মস্তিষ্কে প্রবেশের জন্য। কিন্তু ইনসুলিন অন্যান্য অ্যামাইনো অ্যাসিডকে পেশীর কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে, ফলে ট্রিপটোফ্যান সহজেই মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে।
মস্তিষ্কে পৌঁছানোর পর ট্রিপটোফ্যান বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেরোটোনিন। এই পুরো প্রক্রিয়াটি আম খেলে ঘুম আসার মূল ভিত্তি।
সেরোটোনিন ও মেলাটোনিনের ভূমিকা
ট্রিপটোফ্যান থেকে তৈরি হওয়া সেরোটোনিন হলো একটি শক্তিশালী নিউরোট্রান্সমিটার। সেরোটোনিনের প্রধান কাজ হলো মস্তিষ্ককে শীতল ও শান্ত রাখা। এটি আমাদের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
সেরোটোনিন যখন মস্তিষ্কে বৃদ্ধি পায়, তখন আমাদের শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে থাকে। মস্তিষ্ক শীতল হলে পুরো শরীরেই একটা শিথিলতা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিছানায় বা সোফায় শুয়ে থাকতে মন চায়।
সেরোটোনিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মেলাটোনিন হরমোন তৈরি করা। মেলাটোনিন হলো আমাদের ঘুমের জন্য দায়ী প্রধান হরমোন। সন্ধ্যার পর এই হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায় এবং আমরা ঘুমের জন্য প্রস্তুত হই।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, ট্রিপটোফ্যান সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পর মানুষের রক্তে সেরোটোনিনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। আম খাওয়ার ১২ সপ্তাহ পর সেরোটোনিনের মাত্রা ৬০.৯ শতাংশ এবং ২৪ সপ্তাহ পর ৮২.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
আমের অন্যান্য উপাদানের প্রভাব
আম খেলে ঘুম আসার পেছনে শুধু ট্রিপটোফ্যানই দায়ী নয়। আমের মধ্যে থাকা অন্যান্য উপাদানও এই প্রক্রিয়ায় অবদান রাখে।
ভিটামিন বি৬: আমে থাকা পাইরিডক্সিন বা ভিটামিন বি৬ সরাসরি সেরোটোনিন ও মেলাটোনিন তৈরিতে সাহায্য করে। এই ভিটামিনের অভাব হলে মানুষের মেজাজ খারাপ থাকে এবং ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়।
ম্যাগনেশিয়াম: আমে থাকা ম্যাগনেশিয়াম একটি প্রাকৃতিক পেশী শিথিলকারী। এটি শরীরের টেনশন কমায় এবং মানসিক চাপ দূর করতে সাহায্য করে।
ফাইবার: আমের ফাইবার হজমে সাহায্য করে এবং রক্তের চিনির মাত্রা স্থিতিশীল রাখে। এর ফলে খাওয়ার পর হঠাৎ চিনির মাত্রা বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ার কারণে ঘুমের ব্যাঘাত হয় না।
প্রাকৃতিক চিনি: আমের ফ্রুক্টোজ চিনিযুক্ত খাবারের চেয়ে কম ক্ষতিকর। এটি ইনসুলিনের আকস্মিক বৃদ্ধি ছাড়াই মিষ্টতা প্রদান করে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, গ্রীষ্মকালে আম শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা কমিয়ে দেয়, যা ঘুমের অনুভূতি বাড়াতে পারে। এছাড়াও আমে থাকা বিটা-ক্যারোটিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে প্রদাহ কমায়, যা ভালো ঘুমে সহায়ক।
কখন এবং কতটুকু আম খাওয়া উচিত?
আম খেলে ঘুম আসে বলেই যে যখন-তখন আম খেতে হবে, তা কিন্তু নয়। সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে আম খেলে এর উপকারিতা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়।
সকালের নাশতায়: সকালে এক গ্লাস পানি খাওয়ার পর আম খেলে পুষ্টি উপাদান সবচেয়ে ভালোভাবে শোষিত হয়। এ সময় আমের প্রাকৃতিক চিনি সারাদিনের জন্য শক্তি যোগায়।
ঘুমানোর আগে: রাতে ঘুমানোর ১-২ ঘণ্টা আগে অল্প পরিমাণে আম খেলে ভালো ঘুম হয়। তবে বেশি খাওয়া যাবে না, কারণ এতে হজমে সমস্যা হতে পারে।
পরিমাণ: দিনে একটি মাঝারি সাইজের আম বা আধা থেকে এক কাপ আমের টুকরো যথেষ্ট। বেশি খেলে রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
পরিহার করার সময়: খালি পেটে বা দুপুরে ভরপেট খাবারের পর বেশি আম খাওয়া ঠিক নয়। এতে হজমে ধীরগতি আসে এবং অতিরিক্ত স্থবিরতা অনুভূত হয়।
ডায়াবেটিস রোগীদের আম খাওয়ার আগে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা উচিত। যদিও আমের ফাইবার রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, তবুও সতর্কতা প্রয়োজন।
আম খাওয়ার অন্যান্য স্বাস্থ্য উপকারিতা
আম খেলে ঘুম আসা ছাড়াও এই ফলের রয়েছে অসংখ্য স্বাস্থ্য উপকারিতা। এক কথায় বলা যায়, আম একটি সুপারফুড।
হৃদযন্ত্রের সুরক্ষা: আমে থাকা পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম সঠিক রাখে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। আমের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃদযন্ত্রের কোষ ও রক্তনালীকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
ত্বকের উন্নতি: আমে থাকা ভিটামিন এ ও সি ত্বককে উজ্জ্বল করে এবং বার্ধক্যের চিহ্ন কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত আম খেলে ত্বকের গভীর রেখা ২৩ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।
ক্যান্সার প্রতিরোধ: আমে থাকা ক্যারোটিনয়েড যৌগ স্তন ও কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। আমের মধ্যে থাকা ম্যাঙ্গিফেরিন নামক পলিফেনলও ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ করে।
দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি: আমে থাকা লিউটিন ও জিয়াক্সান্থিন চোখের রেটিনাকে সুরক্ষা দেয় এবং ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের ঝুঁকি কমায়।
হজমশক্তি বৃদ্ধি: আমের এনজাইম হজমে সাহায্য করে এবং পেটের সমস্যা দূর করে। আমের প্রিবায়োটিক ফাইবার উপকারী অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: একটি আমেই দৈনিক ভিটামিন সি এর প্রয়োজনের একটি বড় অংশ পূরণ হয়। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সর্দি-কাশি থেকে রক্ষা করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ: যদিও আমে চিনি আছে, তবে এর ফাইবার দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে। ফলে অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর খাবারের চাহিদা কমে যায়।
আম খেলে ঘুম আসার পেছনে রয়েছে একটি জটিল কিন্তু চমৎকার বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। ট্রিপটোফ্যান, সেরোটোনিন, মেলাটোনিন – এই তিনটি উপাদানের সুন্দর সমন্বয়ে আম আমাদের প্রকৃতিক ঘুমের ওষুধ হিসেবে কাজ করে। তবে মনে রাখতে হবে, পরিমিত পরিমাণে আম খাওয়াই স্বাস্থ্যকর। আমের মৌসুমে তাই নিশ্চিন্তে আম খান, ভালো ঘুম পান এবং সুস্থ থাকুন।