হাঁচি দেওয়ার সময় আমাদের চোখ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায় কেন? বৈজ্ঞানিক কারণ জানুন

হাঁচি দেওয়ার সময় আমাদের চোখ যে আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়, এটা প্রায় সকলেরই জানা একটি বিষয়। কিন্তু এর পেছনের কারণটা কী, তা হয়তো অনেকেই জানেন না। এটি আসলে আমাদের শরীরের…

Debolina Roy

 

হাঁচি দেওয়ার সময় আমাদের চোখ যে আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়, এটা প্রায় সকলেরই জানা একটি বিষয়। কিন্তু এর পেছনের কারণটা কী, তা হয়তো অনেকেই জানেন না। এটি আসলে আমাদের শরীরের একটি অনৈচ্ছিক বা স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা, যা একাধিক জটিল স্নায়বিক কার্যকলাপের ফল। সহজ কথায়, হাঁচির সময় চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়াটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, বরং শরীর নিজেই এই কাজটি করে থাকে। এর মূল কারণ হলো মস্তিষ্ক থেকে আসা একটি সংকেত, যা হাঁচির সাথে জড়িত অন্যান্য পেশীগুলোর পাশাপাশি চোখের পাতা বন্ধ করার জন্যও দায়ী।

এই প্রক্রিয়াটি মূলত আমাদের “ট্রাইজেমিনাল” নামক ক্রেনিয়াল নার্ভ (cranial nerve) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যখন আমাদের নাকে কোনো উত্তেজক পদার্থ, যেমন – ধুলোবালি, ভাইরাস বা অ্যালার্জেন প্রবেশ করে, তখন এই স্নায়ুটি মস্তিষ্কে একটি বার্তা পাঠায়। মস্তিষ্ক তখন ফুসফুসকে গভীর শ্বাস নিতে এবং তারপর প্রচণ্ড গতিতে বাতাস বের করে দিতে নির্দেশ দেয়, যা-ই হলো হাঁচি। একই সময়ে, মস্তিষ্ক চোখের পাতা নিয়ন্ত্রণকারী পেশীগুলোকেও সংকুচিত হওয়ার সংকেত পাঠায়, যার ফলে আমাদের চোখ বন্ধ হয়ে যায়। যদিও এর সঠিক কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন তত্ত্ব প্রচলিত আছে, তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটি হলো এটি একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা।

হাঁচির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং চোখের সংযোগ

হাঁচি, যাকে মেডিকেলের ভাষায় স্টার্নুটেশন (sternutation) বলা হয়, এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। আমাদের শ্বাসতন্ত্রকে বাইরের ক্ষতিকর কণা থেকে মুক্ত রাখার জন্য শরীর এই ব্যবস্থাটি ব্যবহার করে। পুরো প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয় এবং এর প্রতিটি ধাপই মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

ট্রাইজেমিনাল নার্ভের ভূমিকা

আমাদের মুখমণ্ডলের সংবেদন এবং পেশী নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী প্রধান স্নায়ু হলো ট্রাইজেমিনাল নার্ভ। এটি পঞ্চম ক্রেনিয়াল নার্ভ এবং এর তিনটি শাখা রয়েছে, যা চোখ, নাক এবং চোয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত। যখন নাকে কোনো উত্তেজক বস্তু প্রবেশ করে, তখন এই নার্ভের শাখাগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং মস্তিষ্কের মেডুলা অবলংগাটাতে (medulla oblongata) অবস্থিত হাঁচি কেন্দ্রে (sneezing center) সংকেত পাঠায়।

এই সংকেত পাওয়ার পর মস্তিষ্ক বেশ কিছু শারীরিক প্রক্রিয়া শুরু করে:

  • শ্বাস গ্রহণ: ফুসফুসকে যতটা সম্ভব বাতাস দিয়ে ভর্তি করার জন্য গভীর শ্বাস নেওয়ার নির্দেশ দেয়।
  • মুখ এবং গলা বন্ধ করা: নরম তালু (soft palate) এবং জিহ্বার পেছনের অংশ ওপরের দিকে উঠে গিয়ে মুখের রাস্তা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। একইসাথে, স্বরযন্ত্রের ভোকাল কর্ডগুলোও শক্তভাবে বন্ধ হয়ে যায়, যাতে ফুসফুসের ভেতরে বাতাসের চাপ বাড়ে।
  • চোখের পাতা বন্ধ: একই সময়ে, চোখের চারপাশের অরবিকুলারিস অকিউলি (orbicularis oculi) নামক পেশীগুলোকে সংকুচিত হওয়ার জন্য সংকেত পাঠানো হয়, যার ফলে চোখ বন্ধ হয়ে যায়।
  • বাতাস নির্গমন: এরপর হঠাৎ করেই গলা এবং মুখের পেশীগুলো শিথিল হয় এবং ফুসফুসে জমে থাকা বাতাস নাক ও মুখ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বেরিয়ে আসে। বিবিসি সায়েন্স ফোকাস (BBC Science Focus) অনুসারে, এই বাতাসের গতি ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি একটি অনৈচ্ছিক ক্রিয়া (involuntary reflex), যার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটি অনেকটা হাঁটুতে হালকা আঘাত করলে পা যেমন নিজে থেকেই ঝাড়া দিয়ে ওঠে, ঠিক তেমনই একটি ব্যাপার।

কেন চোখ বন্ধ হওয়াটা জরুরি? কিছু প্রচলিত তত্ত্ব

হাঁচির সময় চোখ বন্ধ হওয়ার সঠিক কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো গবেষণা করছেন, তবে কিছু শক্তিশালী তত্ত্ব প্রচলিত আছে।

১. উচ্চ চাপ থেকে চোখকে রক্ষা

সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ত্বটি হলো, হাঁচির সময় আমাদের শরীর যে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে, তা থেকে চোখকে রক্ষা করার জন্যই পাতা বন্ধ হয়ে যায়। হাঁচির ফলে নাক এবং মুখের মাধ্যমে বাতাস বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের মাথা এবং বুকে একটি শক্তিশালী চাপের সৃষ্টি হয়। কিছু বিজ্ঞানীর মতে, এই চাপের একটি ক্ষুদ্র অংশ চোখের রক্তনালী এবং স্নায়ুর উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

যদিও আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ অপথালমোলজি (American Academy of Ophthalmology) অনুযায়ী, হাঁচির চাপে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ চোখের পেছনের পেশী এবং টিস্যুগুলো তাকে সুরক্ষিত রাখে। কিন্তু চোখের ভেতরের সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলোকে অতিরিক্ত চাপ থেকে রক্ষা করার জন্য এটি একটি স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা হতে পারে।

২. জীবাণুর প্রবেশ রোধ করা

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলো, এটি আমাদের চোখকে বাইরের জীবাণু থেকে রক্ষা করে। হাঁচির মাধ্যমে আমাদের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ জীবাণু, ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। হাঁচির সময় চোখ খোলা রাখলে সেই জীবাণুগুলো আবার চোখে প্রবেশ করে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই চোখ বন্ধ করে শরীর মূলত নিজেকেই সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, হাঁচি এবং কাশির মাধ্যমে নির্গত ড্রপলেটগুলো বিভিন্ন রোগ ছড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ।

৩. এটি একটি সমন্বিত অনৈচ্ছিক ক্রিয়া

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, চোখ বন্ধ হওয়াটা হাঁচি প্রক্রিয়ারই একটি অংশ, যার কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই। মস্তিষ্ক যখন হাঁচির জন্য একাধিক পেশীকে সংকুচিত হওয়ার নির্দেশ দেয়, তখন চোখের পেশীগুলোও সেই নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত থাকে। অর্থাৎ, হাঁচি দেওয়ার জন্য যেসব স্নায়বিক পথ (neural pathways) ব্যবহৃত হয়, সেগুলো চোখের পাতা বন্ধ করার স্নায়বিক পথের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাই একটি ঘটলে অন্যটিও ঘটে যায়।

পরিসংখ্যান ও কিছু তথ্য

হাঁচি এবং এর সাথে সম্পর্কিত শারীরিক প্রক্রিয়া নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। নিচে কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো:

বিষয় তথ্য উৎস
হাঁচির গতি ঘণ্টায় প্রায় ১০০ মাইল (১৬০ কিমি) পর্যন্ত হতে পারে। লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস (Library of Congress)
জীবাণুর সংখ্যা একটি হাঁচিতে প্রায় ১,০০,০০০ জীবাণু বাতাসে ছড়াতে পারে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT)
স্নায়ুর ভূমিকা পঞ্চম (ট্রাইজেমিনাল) এবং দশম (ভেগাস) ক্রেনিয়াল নার্ভ হাঁচি নিয়ন্ত্রণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH), যুক্তরাষ্ট্র
চোখ খোলা রাখা কিছু মানুষ চেষ্টা করলে হাঁচির সময় চোখ খোলা রাখতে পারেন, তবে এটি অত্যন্ত কঠিন এবং স্বাভাবিক নয়। বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিষয়ক জার্নাল

চোখ খোলা রেখে হাঁচি দেওয়া কি সম্ভব?

বেশিরভাগ মানুষের জন্য হাঁচির সময় চোখ খোলা রাখা প্রায় অসম্ভব। এটি একটি শক্তিশালী অনৈচ্ছিক ক্রিয়া হওয়ায় একে প্রতিহত করা কঠিন। তবে কিছু মানুষ বিশেষ অনুশীলনের মাধ্যমে এটি করতে সক্ষম হয়েছেন বলে দাবি করেন, যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। চিকিৎসকরা সাধারণত এমনটি চেষ্টা করার বিরুদ্ধে পরামর্শ দেন, কারণ এতে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি থাকতে পারে।

শেষ পর্যন্ত, হাঁচির সময় চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়া আমাদের শরীরের একটি স্বাভাবিক এবং প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা। এটি মস্তিষ্ক, স্নায়ু এবং পেশীগুলির মধ্যে একটি জটিল সমন্বয়ের ফল, যা আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অনৈচ্ছিক ক্রিয়াটি আমাদের শরীরকে সম্ভাব্য ক্ষতি এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য প্রকৃতির এক অসাধারণ প্রকৌশলের উদাহরণ।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।