ননীবালা দেবী স্মরণীয় কেন? বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দীর অমর কাহিনী

Srijita Chattopadhay 8 Min Read

Nanibala Devi memorable: ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু নাম আছে যারা নিজেদের জীবন দিয়ে গড়ে তুলেছেন অমর কীর্তি। তাঁদের মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে ননীবালা দেবী। তিনি শুধু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না, বরং ছিলেন বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী। আজও ননীবালা দেবী স্মরণীয় কারণ তাঁর সাহসিকতা, দেশপ্রেম এবং অদম্য মনোবল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। একজন সাধারণ বাল্যবিধবা থেকে কীভাবে তিনি হয়ে উঠলেন বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা, সেই গৌরবময় কাহিনী জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে।

প্রাথমিক জীবন ও চ্যালেঞ্জ

১৮৮৮ সালে হাওড়া জেলার বালিতে এক মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ননীবালা দেবী। তাঁর পিতার নাম ছিল সূর্যকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতার নাম গিরিবালা দেবী। সেই যুগের সামাজিক প্রথা অনুযায়ী মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৮৯৯ সালে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু ভাগ্য তাঁর সাথে নিষ্ঠুর খেলা খেলল। বিয়ের মাত্র পাঁচ বছর পর, ১৯০৪ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি বাল্যবিধবা হয়ে পড়েন।

শশুরবাড়িতে আর জায়গা হলো না তাঁর। ফিরে এলেন পিতৃগৃহে। কিন্তু ননীবালা দেবী স্মরণীয় হওয়ার প্রথম কারণ এখানেই। তিনি সমাজের প্রচলিত নিয়মে আবদ্ধ থাকতে রাজি হলেন না। নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চাইলেও সমাজের নানা বাধার কারণে তাঁকে বাড়ি ছাড়তে হয়। অবশেষে আশ্রয় নিলেন আড়িয়াদহ মিশনে।

বিপ্লবী জীবনের সূচনা

ননীবালা দেবীর জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় যখন তিনি তাঁর ভাইপো বিপ্লবী অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে আসেন। অমরেন্দ্র ছিলেন যুগান্তর দলের একজন বিখ্যাত নেতা। তাঁরই হাত ধরে ননীবালা দেবী বিপ্লবী আন্দোলন ও যুগান্তর দলের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারেন। এই সময় থেকেই শুরু হয় তাঁর বিপ্লবী জীবন।

সাহসী অভিযান ও বিপ্লবী কার্যক্রম

রামচন্দ্র মজুমদারের সাথে সাক্ষাৎ

১৯১৫ সালের একটি ঘটনা ননীবালা দেবীকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। আলিপুর জেলে বন্দী বিপ্লবী রামচন্দ্র মজুমদারের কাছ থেকে গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি এক অসাধারণ কাণ্ড করেছিলেন। তিনি রামচন্দ্রের স্ত্রী সেজে জেলে দেখা করতে গেলেন পুলিশকে কিছুমাত্র সন্দেহ করতে না দিয়ে।

সেই সময়ে একজন বিধবা হিন্দু মহিলার শাঁখা-সিঁদুর পরে অন্যের স্ত্রী সাজা ছিল প্রায় অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু দেশের জন্য তিনি সেই কাজ করলেন। রামচন্দ্রের কাছে লুকানো মাউজার পিস্তলের খোঁজ নিয়ে এলেন। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় ননীবালা দেবী স্মরণীয় কেন – তাঁর অসাধারণ সাহসিকতা ও মানসিক দৃঢ়তার জন্য।

বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়দাতা

ননীবালা দেবী বিভিন্ন সময়ে পলাতক বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। প্রথমে রিষড়ায় এবং পরে চন্দননগরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি গৃহকর্ত্রীর ছদ্মবেশে থাকতেন। দিনের বেলা বিপ্লবীরা ঘরের ভেতরে লুকিয়ে থাকতেন, রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়তেন কাজে। পুলিশ যখনই হানা দিত, কোনো না কোনোভাবে বিপ্লবীরা পালিয়ে যেতে পারতেন।

তিনি সুতো কেটে খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন বলে গরিব ব্রাহ্মণ মহিলার প্রতি ইংরেজ পুলিশের সন্দেহ হতো না। এভাবে তিনি বিপ্লবীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারতেন।

গ্রেফতার ও কারাভোগ

পেশোয়ারে গ্রেফতার

যখন পুলিশ ননীবালা দেবীকে সন্দেহ করতে শুরু করল, তখন গ্রেফতারি এড়াতে তিনি পেশোয়ার চলে যান। কিন্তু সেখানেও পুলিশের হাত থেকে রেহাই পেলেন না। কলেরা রোগে আক্রান্ত অবস্থায় পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁকে প্রথমে বেনারস জেলে পাঠানো হয়।

বেনারসে অমানবিক নির্যাতন

বেনারস জেলে ননীবালা দেবীর ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার। সেখানকার পুলিশ সুপার জিতেন ব্যানার্জি ছিলেন বাঙালি ব্রাহ্মণ, কিন্তু তিনি স্বজাতির একটি মেয়েকে অশ্রাব্য অপমান করতেন। দুই জমাদারনি ননীবালাকে জোর করে ধরে মাটিতে ফেলে তাঁর শরীরের গোপন অংশে লঙ্কাবাটা ঢুকিয়ে দিত।

কবরের মতো আলো-বাতাসহীন একটি কুঠুরিতে তাঁকে আটকে রাখা হতো। পরপর তিন দিন আধঘণ্টা করে সেই শাস্তি কুঠুরিতে রেখে বের করে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। তৃতীয় দিনে প্রায় ৪৫ মিনিট সেই ঘরে রাখার ফলে অক্সিজেনের অভাবে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন।

কিন্তু এত অত্যাচারের পরেও ননীবালা দেবী স্মরণীয় কারণ তিনি একটি কথাও মুখ খোলেননি। বিপ্লবীদের কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করেননি।

মহিলাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ: মহিলা সম্মান সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে পান 7.5% সুদ!

প্রেসিডেন্সি জেলে ২১ দিনের অনশন

বেনারস থেকে তাঁকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করলে কারা কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। তিনি জানিয়ে দিলেন যে বাগবাজারে শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী শারদা মায়ের কাছে রাখা হলে তবেই তিনি অনশন ভাঙবেন।

সুপারিনটেন্ডেন্ট গোল্ডি সেই দরখাস্ত ছিঁড়ে ফেললে তিনি তাকে চড় মারেন। একজন নেটিভ বন্দিনীর এই স্পর্ধা দেখে ব্রিটিশরা তাঁকে ১৮১৮ সালের ৩ নং রেগুলেশনে স্টেট প্রিজনার হিসেবে আটক রাখে। বাংলায় তিনিই ছিলেন একমাত্র মহিলা স্টেট প্রিজনার। তিনি টানা ২১ দিন অনশন করেছিলেন।

মুক্তি ও জীবনের শেষ পর্যায়

১৯১৯ সালে সাধারণ ক্ষমার অধীনে ননীবালা দেবী মুক্তি পান। কিন্তু পৈতৃক বাড়িতে আর ঠাঁই হলো না। বিধবা হয়েও পরপুরুষের সাথে একসাথে থাকা, পেশোয়ার যাওয়া – এসব অপরাধের দীর্ঘ তালিকা তৈরি হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে।

নিঃসহায় অবস্থায় তিনি কলকাতায় দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করতে থাকেন। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলে এক সাধুর হাতে সুস্থ হন। এরপর তিনি সন্ন্যাসী জীবন গ্রহণ করেন এবং গেরুয়া বসন ধারণ করেন।

১৯৬৭ সালের মে মাসে তিনি চিরতরে বিদায় নেন। কিন্তু তাঁর আত্মত্যাগের কাহিনী ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।

ননীবালা দেবী স্মরণীয় কেন: তাঁর অবদান ও প্রভাব

প্রথম মহিলা রাজবন্দী হিসেবে ইতিহাসে স্থান

ননীবালা দেবী স্মরণীয় প্রধানত এই কারণে যে তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল। এটি ছিল বাঙালি নারীর জন্য এক অভূতপূর্ব সম্মান ও গৌরবের বিষয়।

বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের পথপ্রদর্শক

তাঁর সাহসী কার্যক্রম অন্যান্য বাঙালি মেয়েদের অনুপ্রাণিত করেছিল। ননীবালা দেবীর কাজ প্রমাণ করেছিল যে স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীরাও পুরুষদের সমান ভূমিকা রাখতে পারেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় পরবর্তীতে মেদিনীপুরের মেয়েরা খোলাখুলি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।

অসাধারণ সাহসিকতা ও দেশপ্রেম

একজন বাল্যবিধবার পক্ষে সেই যুগে এত বড় ঝুঁকি নেওয়া ছিল অকল্পনীয়। ননীবালা দেবী স্মরণীয় কারণ তিনি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার চেয়ে দেশের স্বাধীনতাকে বড় করে দেখেছিলেন। তাঁর এই দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ আজও অনুপ্রেরণার উৎস।

নির্যাতনের বিরুদ্ধে অটুট মনোবল

কারাগারে অমানবিক নির্যাতনের মুখেও তিনি মুখ খোলেননি। এই মানসিক দৃঢ়তা দেখিয়েছিল যে সাধারণ একজন বাঙালি নারীর মধ্যেও কী অপরিসীম শক্তি লুকিয়ে থাকতে পারে।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা

নারী ক্ষমতায়নের অগ্রদূত

আজকের নারী ক্ষমতায়নের যুগে ননীবালা দেবীর জীবন বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে সামাজিক বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে একজন নারী নিজের আদর্শের জন্য লড়াই করতে পারেন।

আত্মত্যাগের আদর্শ

আত্মকেন্দ্রিক এই যুগে তাঁর নিঃস্বার্থ দেশসেবা আমাদের শেখায় কীভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে সমষ্টির কল্যাণকে প্রাধান্য দিতে হয়।

সত্যের পক্ষে অবিচল থাকার শিক্ষা

যে কোনো প্রকার অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখেও সত্যের পক্ষে অবিচল থাকার যে শিক্ষা তিনি দিয়ে গেছেন, তা আজকের প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান।

আজও ননীবালা দেবী স্মরণীয় কারণ তিনি শুধু একজন বিপ্লবী ছিলেন না, ছিলেন একটি আদর্শের প্রতীক। বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী হিসেবে তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর জীবনকাহিনী আমাদের শেখায় যে সাহস, দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগ দিয়ে যে কোনো বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।

একজন সাধারণ বাল্যবিধবা থেকে কীভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা, সেই গল্প প্রতিটি প্রজন্মের কাছে ননীবালা দেবী স্মরণীয় করে রাখে। তাঁর আদর্শ ও ত্যাগ আগামী প্রজন্মের জন্য চিরকালীন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আসুন, আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং তাঁর দেখানো পথে দেশ ও সমাজের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করি। 

Share This Article