পাক অধিকৃত কাশ্মীর (PoK) দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বিতর্কিত ভূখণ্ডগুলির মধ্যে একটি, যা ১৯৪৭-৪৮ সালের প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভারত এই অঞ্চলকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাবি করে এবং পাকিস্তানের অধিকার অবৈধ বলে মনে করে। সাম্প্রতিক ঘটনা, যেমন ২০২৫ সালের এপ্রিলে পাহালগামে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বরাবর বাড়তে থাকা উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে, পাক অধিকৃত কাশ্মীরের রণনৈতিক গুরুত্ব আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে।
পাক অধিকৃত কাশ্মীর: একটি পরিচয়
পাক অধিকৃত কাশ্মীর বলতে জম্মু ও কাশ্মীরের সেই অংশ বোঝায় যেটি ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর থেকে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই ভূখণ্ড মূলত দুটি অংশে বিভক্ত:
-
আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর (AJK) – দক্ষিণাংশ, যার রাজধানী মুজাফফরাবাদ
-
গিলগিট-বালতিস্তান (GB) – উত্তরাংশ, যা কৌশলগতভাবে চীন এবং আফগানিস্তানের সীমানার সাথে সংযুক্ত
পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মোট আয়তনের ৮৬% গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চল দখল করে, যা ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় কাশ্মীরের মহারাজা প্রথমে স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে তিনি শেষ পর্যন্ত ভারতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর থেকে এই অঞ্চল নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়:
সময়কাল | ঘটনা |
---|---|
১৯৪৭-৪৮ | প্রথম ভারত-পাক যুদ্ধ, জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি |
১৯৪৯ | করাচি চুক্তি দ্বারা যুদ্ধবিরতি রেখা প্রতিষ্ঠা |
১৯৬৫ | দ্বিতীয় ভারত-পাক যুদ্ধ |
১৯৭১ | তৃতীয় ভারত-পাক যুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন |
১৯৯৯ | কারগিল যুদ্ধ |
১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ রেখা (Line of Control) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা কাশ্মীরকে দুটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করে। এই চুক্তি সত্ত্বেও, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলতে থাকে এবং ১৯৯৪ সালে পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রকৃতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
পাক অধিকৃত কাশ্মীরের কৌশলগত গুরুত্ব
ভৌগোলিক অবস্থান ও সংযোগ
পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি মধ্য এশিয়ায় ভারতের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করতে পারে। কাশ্মীর ছাড়া, ভারতের মধ্য এশিয়ায় স্থল বাণিজ্য পথের সাথে সংযোগ থাকবে না, যা দেশটির ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে সীমিত করে। এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ভারতকে সেই একই স্থল পথে প্রত্যক্ষ অ্যাক্সেস দেবে যা পাকিস্তান বর্তমানে উপভোগ করছে।
ভারত বর্তমানে আরব সাগর ও ইরানি বন্দরগুলির মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে তার পণ্য রপ্তানি করে। আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়া, রাশিয়া ও ইউরোপে পৌঁছনো বাণিজ্য পথের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে ভারত। কাশ্মীরের মাধ্যমে, এই সংযোগ আরও সহজ ও প্রত্যক্ষ হতে পারে।
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করে, যা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের অংশ। ৬০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের এই প্রকল্প চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ, যা পাকিস্তানকে চীনের সাথে সংযুক্ত করে।
ভারত এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে, কারণ:
-
এটি কাশ্মীরের উপর ভারতের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে
-
এটি অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়ায়
-
এটি ভারতের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য হুমকি
CPEC দ্বারা চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি ভারতের কাছে গভীর উদ্বেগের বিষয়, কারণ এটি ভারতকে কৌশলগতভাবে ঘিরে ফেলার চীনের “স্ট্রিং অফ পার্লস” কৌশলের অংশ বলে মনে করা হয়।
নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ
সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি
ভারতের জন্য পাক অধিকৃত কাশ্মীরের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হল এর মাধ্যমে সীমান্ত-পারের সন্ত্রাসবাদের বিস্তার। এই অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে লস্কর-ই-তৈবা, জইশ-ই-মুহম্মদ এবং হিজবুল মুজাহিদিনের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করেছে।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ভিমবেরে, কোতলি এবং নিলাম উপত্যকার মতো জায়গায় সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবির সনাক্ত করেছে। ২০২৫ সালের এপ্রিলে পাহালগামে ঘটা সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন লোক নিহত হয়, যারা মধ্যে পর্যটক ও সেনা সদস্যরা ছিলেন। ভারত দাবি করেছে যে আক্রমণকারীরা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের সন্ত্রাসী ঘাঁটি থেকে আসা।
সামরিক গুরুত্ব
পাক অধিকৃত কাশ্মীর চীন, আফগানিস্তান এবং তাজিকিস্তানের কাছাকাছি অবস্থিত, যা রুশ প্রভাবের অঞ্চল। এই অবস্থান ভারতকে উত্তর ও পশ্চিম সীমান্তে কৌশলগত সুবিধা দিতে পারে। বর্তমানে, ভারতের সেনাবাহিনীকে পাকিস্তান ও চীন – দুটি পরমাণু শক্তির সাথে দীর্ঘ সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে হয়।
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী: ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘ ট্রেন রুট চালু হতে চলেছে!
পাক অধিকৃত কাশ্মীর সম্পর্কে ভারতের সাংবিধানিক অবস্থান
ভারত দৃঢ়ভাবে মনে করে যে:
-
পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ
-
১৯৯৪ সালে ভারতীয় সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস করে যে পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের সার্বভৌম অধিকারভুক্ত
-
ভারত তথাকথিত “আজাদ কাশ্মীর সরকার” কে স্বীকৃতি দেয় না এবং সেখানে যেকোনো কার্যকলাপ, নির্বাচন সহ, অবৈধ বলে মনে করে
২০২৫ সালের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী: আলোচনার কেন্দ্রে পাক অধিকৃত কাশ্মীর
পাহালগাম সন্ত্রাসী হামলার প্রভাব
২০২৫ সালের এপ্রিলে সংঘটিত পাহালগাম সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক তীব্রভাবে অবনতি হয়েছে। ভারত পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করেছে নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায়:
-
ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য পুনরায় ব্যক্ত করেছে
-
নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে ও সীমান্ত পারে নজরদারি ও ড্রোন অপারেশন বৃদ্ধি পেয়েছে
-
ভারত কথিত সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলির উপর সুনির্দিষ্ট প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালিয়েছে
কূটনৈতিক উত্তেজনা
হামলার পর, ভারত পাকিস্তানি হাইকমিশনারকে তলব করে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী অবকাঠামো ভেঙে ফেলার দাবি জানিয়েছে। প্রতিক্রিয়ায়, পাকিস্তান শিমলা চুক্তিসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্থগিত করেছে, যা আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনরুদ্ধার করলে ভারত লাভবান হবে:
-
মধ্য এশিয়ার বাজারে প্রত্যক্ষ অ্যাক্সেস
-
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা
-
সম্ভাব্য হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্পগুলি থেকে শক্তি সম্পদ
-
পর্যটন সম্ভাবনার উন্নয়ন
ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
যাইহোক, পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনরুদ্ধারের পথে অনেক বাধা রয়েছে:
-
পাকিস্তান এবং চীন উভয় দেশেরই সামরিক প্রতিরোধের সম্ভাবনা
-
পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি
-
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
-
অঞ্চলে দীর্ঘদিনের অস্থিরতার সম্ভাবনা
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
বিশ্ব রাজনীতিতে পাক অধিকৃত কাশ্মীর একটি জটিল ইস্যু। ভারত জাপান, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, ফ্রান্স, ভুটান, অস্ট্রেলিয়া, আফগানিস্তান, কানাডা, উত্তর কোরিয়া এবং যুক্তরাজ্যের সমর্থন পায়, যখন পাকিস্তান চীন, তুরস্ক এবং আরব দেশগুলির সাথে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
চীন পাক অধিকৃত কাশ্মীরে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী না হলেও, বিশ্বের সেই অংশে স্থিতিশীলতায় খুব আগ্রহী। যেকোনো দেশের, বিশেষ করে এই তিনটি জনবহুল দেশের শক্তিশালী ও উন্নত অর্থনীতির জন্য নিরাপদ পরিবহন করিডোর প্রয়োজন, যা দিয়ে পণ্য, মূলধন ও মানুষ চলাচল করে।
পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের জন্য শুধু একটি ভূখণ্ডই নয়, বরং একটি কৌশলগত, অর্থনৈতিক, এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়তা। ১৯৪৭ সাল থেকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই বিবাদপূর্ণ ভূখণ্ড উভয় দেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সীমান্ত-পারের সন্ত্রাসবাদ রোধ, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের প্রতিরোধ এবং মধ্য এশিয়ায় প্রবেশদ্বার হিসেবে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের গুরুত্ব ভারতকে এই অঞ্চলের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে বাধ্য করেছে। ২০২৫ সালের পাহালগাম সন্ত্রাসী হামলার পর, এই অঞ্চল আবারও আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, যা শক্তি সমীকরণ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
যতক্ষণ না এই বিবাদের একটি স্থায়ী সমাধান হচ্ছে, ততক্ষণ পাক অধিকৃত কাশ্মীর দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অস্থির ও ঝুঁকিপূর্ণ হটস্পট হিসেবে থেকে যাবে, যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘর্ষের একটি প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করবে।