আজকের ডিজিটাল যুগে গুগল (Google) ছাড়া আমাদের জীবন যেন প্রায় অচল। যেকোনো তথ্য খোঁজা থেকে শুরু করে রাস্তা চেনা, ইমেল পাঠানো বা বিনোদন – সবকিছুতেই গুগলের অবাধ বিচরণ। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই টেক জায়ান্টের জন্মদিন নিয়ে একটি মজার বিভ্রান্তি রয়েছে? যদিও গুগল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর, কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তারা তাদের জন্মদিন পালন করে আসছে ২৭শে সেপ্টেম্বর।কিন্তু কেন এই তারিখ বিভ্রাট? এই প্রতিবেদনে আমরা গুগলের জন্মদিনের পেছনের আসল রহস্য এবং এর পথচলার রোমাঞ্চকর ইতিহাস তুলে ধরব।
একটি তারিখ, নানা কথা
প্রতি বছর ২৭শে সেপ্টেম্বর গুগল তার হোমপেজে একটি বিশেষ ডুডল (Doodle) দিয়ে জন্মদিন পালন করে, যা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ব্যবহারকারীর নজর কাড়ে।2 কিন্তু অনেকেই জানেন না যে, গুগলের আসল জন্মদিন বা প্রতিষ্ঠা দিবস হলো ৪ঠা সেপ্টেম্বর। ১৯৯৮ সালের এই দিনেই ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘Google Inc.’ নামে কোম্পানিটিকে নথিভুক্ত করেন। তাহলে কেন এই বিশেষ দিনটিকে পালনের জন্য বেছে নেওয়া হলো? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে গুগলের ক্রমবিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের মধ্যে।
গুগলের জন্ম ও তার বেড়ে ওঠার গল্প
১৯৯৫ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির দুই পিএইচডি ছাত্র, ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন, একটি রিসার্চ প্রজেক্ট হিসেবে ‘ব্যাকরাব’ (BackRub) নামে একটি সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করেন।3 তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (WWW) বিশাল তথ্যভান্ডারকে সুসংগঠিত করা এবং ব্যবহারকারীদের জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক তথ্য খুঁজে বের করা।4 তাদের তৈরি করা ‘পেজর্যাঙ্ক’ (PageRank) অ্যালগরিদম ওয়েবসাইটগুলির প্রাসঙ্গিকতা নির্ধারণে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।5
১৯৯৭ সালে, তারা ‘ব্যাকরাব’ নামটি পরিবর্তন করে ‘গুগল’ (Google) রাখেন। এই নামটি আসলে ‘googol’ শব্দের একটি ভুল বানান থেকে নেওয়া, যার গাণিতিক অর্থ হলো ১-এর পর ১০০টি শূন্য।6 এই নামের মাধ্যমে তারা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তাদের সার্চ ইঞ্জিনটি বিপুল পরিমাণ তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে সক্ষম। সান মাইক্রোসিস্টেমসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্ডি বেখটোলশেইমের কাছ থেকে ১ লক্ষ ডলারের প্রাথমিক বিনিয়োগ পাওয়ার পর, ১৯৯৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো পার্কের একটি গ্যারেজে তাদের কোম্পানি শুরু করেন। এই গ্যারেজটি ছিল তাদের বন্ধু সুজান ওয়াজসিকির, যিনি পরে ইউটিউবের সিইও হন।
কেন ২৭শে সেপ্টেম্বর জন্মদিন পালন করা হয়?
গুগলের জন্মদিন পালনের তারিখটি বেশ কয়েকবার পরিবর্তিত হয়েছে। প্রথম সাত বছর, অর্থাৎ ২০০৫ সাল পর্যন্ত, গুগল ৪ঠা সেপ্টেম্বরকেই তাদের জন্মদিন হিসেবে পালন করত। কিন্তু ২০০৫ সাল থেকে তারা ২৭শে সেপ্টেম্বর জন্মদিন পালন করা শুরু করে। এই পরিবর্তনের পিছনে বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণের কথা বলা হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্যটি হলো একটি বিশেষ মাইলফলক অর্জন।
বিভিন্ন রিপোর্ট এবং গুগল নিজেই বিভিন্ন সময়ে যা ইঙ্গিত দিয়েছে, সেই অনুযায়ী, ২০০৫ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর গুগল তাদের সার্চ ইনডেক্সে একটি রেকর্ড সংখ্যক ওয়েবপেজ অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। অর্থাৎ, সেদিন গুগল তার ডেটাবেসকে এতটাই সমৃদ্ধ করেছিল যে তা প্রতিযোগী ইয়াহু (Yahoo)-কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্যই এই দিনটিকে তারা প্রতীকী জন্মদিন হিসেবে বেছে নেয়।
আরেকটি প্রচলিত ধারণা হলো, গুগলের প্রথম জন্মদিন ডুডলটি ২০০২ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই থেকে এই তারিখটি গুগলের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে এবং পরবর্তীকালে এই দিনটিকেই আনুষ্ঠানিক জন্মদিন হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদিও এই বিষয়ে গুগলের পক্ষ থেকে কোনো দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা আসেনি, তবে এই মাইলফলক এবং ডুডলের সংযোগটিই সবচেয়ে বেশি গৃহীত।
গুগলের প্রভাব: সমাজ, অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রায়
একটি গ্যারেজে শুরু হওয়া কোম্পানিটি আজ বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী কর্পোরেশনে পরিণত হয়েছে, যার মূল সংস্থা অ্যালফাবেট ইনকর্পোরেটেড (Alphabet Inc.) গুগলের প্রভাব আজ আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যমান।
- তথ্যের সহজলভ্যতা: গুগল সার্চের মাধ্যমে যেকোনো তথ্য এখন আঙুলের ডগায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই এটি একটি অপরিহার্য হাতিয়ার।
- যোগাযোগ ও ব্যবসা: জিমেইল (Gmail), গুগল মিট (Google Meet), এবং গুগল ওয়ার্কস্পেস (Google Workspace) পেশাদার এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের ধরন বদলে দিয়েছে। অন্যদিকে, গুগল অ্যাডস (Google Ads) এবং গুগল অ্যানালিটিক্স (Google Analytics) ডিজিটাল মার্কেটিং এবং ব্যবসার প্রসারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।
- ন্যাভিগেশন ও ভ্রমণ: গুগল ম্যাপস (Google Maps) ছাড়া আজ রাস্তাঘাট চেনা বা কোনো নতুন জায়গায় যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এটি ট্র্যাফিক আপডেট থেকে শুরু করে লোকাল গাইড, সবকিছুতেই সাহায্য করে।
- বিনোদন ও জীবনযাত্রা: ইউটিউব (YouTube), অ্যান্ড্রয়েড (Android) অপারেটিং সিস্টেম, এবং গুগল প্লে স্টোর (Google Play Store) আমাদের বিনোদন এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।9
বিশ্ব অর্থনীতিতেও গুগলের প্রভাব অপরিসীম। লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা থেকে শুরু করে ছোট এবং মাঝারি ব্যবসার প্রসারে গুগল এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
ভবিষ্যতের দিকে গুগল: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং নতুন উদ্ভাবন
বর্তমানে গুগল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)-এর দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দিচ্ছে। তাদের গুগল এআই (Google AI) বিভাগ এবং ডিপমাইন্ড (DeepMind) সংস্থাটি এই ক্ষেত্রে যুগান্তকারী গবেষণা চালাচ্ছে। গুগল সার্চে এখন জেনারেটিভ এআই (Generative AI) যুক্ত হয়েছে, যা ব্যবহারকারীদের আরও সঠিক এবং প্রাসঙ্গিক উত্তর দিতে সক্ষম।
ভবিষ্যতে গুগল স্ব-চালিত গাড়ি (Waymo), স্বাস্থ্যসেবা (Verily), এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর মতো ক্ষেত্রেও তাদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে।
উপসংহার
সুতরাং, গুগলের জন্মদিন নিয়ে যে বিভ্রান্তি, তা আসলে তাদের সাফল্যের একটি প্রতীকী উদযাপন। ৪ঠা সেপ্টেম্বর তাদের আইনি প্রতিষ্ঠা দিবস হলেও, ২৭শে সেপ্টেম্বর দিনটি তাদের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের এক মাইলফলককে স্মরণ করিয়ে দেয়। একটি রিসার্চ প্রজেক্ট থেকে শুরু করে আজকের এই বিশাল প্রযুক্তিগত সাম্রাজ্য তৈরি করার পেছনে রয়েছে ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিনের দূরদৃষ্টি এবং নিরন্তর উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা। তাই ২৭শে সেপ্টেম্বর তারিখটি কেবল একটি জন্মদিন নয়, এটি গুগলের যাত্রাপথের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের স্মারক।