হিন্দু ধর্মে দেবী লক্ষ্মীকে ধন-সম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী হিসেবে পূজা করা হয়। তাঁর বাহন হিসেবে সাদা পেঁচাকে দেখা যায়, যা অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কারণ সাধারণত পেঁচাকে অশুভ প্রাণী হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে পুরাণে এর পিছনে একটি গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে।
পেঁচা লক্ষ্মীর বাহন হওয়ার পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, পেঁচা ধৈর্য, বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে সম্পদ ও সমৃদ্ধির আশীর্বাদ বহন করে। পেঁচা লক্ষ্মীর ভক্তদের মনে করিয়ে দেয় যে তারা যেন শুধুমাত্র বাহ্যিক সম্পদের পিছনে না ছুটে, বরং প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দিকে মনোযোগী হয।
দ্বিতীয়ত, পেঁচা রাতের প্রাণী হওয়ায় অন্ধকারেও দেখতে পায়। এটি প্রতীকী অর্থে বোঝায় যে লক্ষ্মীর কৃপা থাকলে মানুষ জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার সময়েও সঠিক পথ খুঁজে পায়। তৃতীয়ত, পেঁচা খুব দক্ষ শিকারী। এটি ইঁদুর ধরতে পারদর্শী, যা ধানের ক্ষেতে ও গোলাঘরে ক্ষতি করে। যেহেতু ধান লক্ষ্মীর প্রতীক, তাই পেঁচা লক্ষ্মীর সম্পদ রক্ষার কাজ করে।
বাড়িতে পেঁচার বাসা তৈরি করলে ভাগ্য খুলে যাবে, জেনে নিন কেন এই পাখি এত ভাগ্যবান
চতুর্থত, পুরাণে বলা হয়েছে যে দেবী লক্ষ্মীর অর্ধেক অংশ অলক্ষ্মী। লক্ষ্মী ব্রহ্মার মুখের উজ্জ্বল অংশ থেকে এবং অলক্ষ্মী তাঁর পিঠের অন্ধকার দিক থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। পেঁচা লক্ষ্মীর পায়ের কাছে বসে থাকে, যা অলক্ষ্মী ও তার অশুভ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রতীক।
বাংলা অঞ্চলে লক্ষ্মীর পেঁচাকে ‘পেচাকা’ নামেও ডাকা হয়। এই পেচাকা শুধু ইঁদুরই নয়, অন্যান্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গও শিকার করে যা কৃষি সম্পদের ক্ষতি করে। এভাবে পেঁচা লক্ষ্মীর সম্পদ রক্ষার কাজ করে।
হিন্দু পুরাণে একটি কাহিনী আছে যে আশ্বিনের শেষ পূর্ণিমার রাতে দেবী লক্ষ্মী নিজে ঘরে ঘরে খোঁজ নিতে আসেন কে জেগে আছে। এই রাতে যে ব্যক্তি জেগে থেকে দেবীর আরাধনা করেন, তিনি তাঁর ঘরে প্রবেশ করেন। এই উপলক্ষ্যে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা পালিত হয়।
পেঁচার সাথে লক্ষ্মীর সম্পর্ক শুধু হিন্দু ধর্মেই নয়, গ্রিক ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতেও পেঁচাকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। তাদের রাত্রিকালীন সজাগতা পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের অধ্যয়নশীলতার সাথে তুলনা করা হয়।
অনেকে ভুল করে ‘উল্লু’ শব্দটিকে বোকামি বা নির্বুদ্ধিতার সাথে যুক্ত করেন। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বরং পেঁচা একটি বুদ্ধিমান প্রাণী। তারা এমন পরিস্থিতিতেও টিকে থাকতে ও খাবার সংগ্রহ করতে পারে যেখানে অন্য প্রাণীরা ব্যর্থ হয়।
পেঁচার অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলি তাকে সম্পদ ও জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারা অত্যন্ত কুশলী শিকারী, যা দক্ষতা ও কর্মঠতার প্রতীক। তাদের বিশাল চোখ ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির প্রতীক। তাদের নীরব উড়ান ক্ষমতা গোপনীয়তা ও বিচক্ষণতার প্রতীক।
বাংলা সংস্কৃতিতে সাদা পেঁচাকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। বাঙালি পরিবারে সাদা পেঁচাকে কখনও তাড়ানো হয় না, কারণ এটি সৌভাগ্য ও সম্পদের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এমনকি সাদা পেঁচাকে ব্রাহ্মণ শ্রেণীর সমতুল্য মনে করা হয়।
কিছু লোক পেঁচাকে অশুভ প্রাণী হিসেবে মনে করেন। এর পিছনে একটি কারণ হল পেঁচার উচ্চ শিকার সফলতার হার। লোকে মনে করে যে যদি একটি পেঁচা বাড়ির কাছে বসে থাকে, তাহলে কিছু খারাপ ঘটতে পারে। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। বরং পেঁচার উপস্থিতি সতর্কতা ও প্রস্তুতির প্রতীক।
প্রাচীন যুগে পেঁচারা আকারে অনেক বড় ছিল, শকুন বা সোনালি ঈগলের মতো। তাই সেই সময়ের মানুষ পেঁচা আক্রমণের ভয়ে ভীত থাকত। এই ভয় থেকেই পেঁচাকে অশুভ প্রাণী হিসেবে দেখার প্রবণতা শুরু হয়েছিল।
তবে হিন্দু শাস্ত্রে পেঁচাকে সবসময়ই “সৌভাগ্য”, “সম্পদ”, “সমৃদ্ধি” ও “লাভের” প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে। পেঁচাকে পাখিদের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেণীর সমতুল্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে কাক ও শকুনকে শূদ্র শ্রেণীর সমতুল্য মনে করা হয়।
পেঁচা লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে একটি গভীর বার্তা বহন করে। এটি মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃত সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে শুধু কঠোর পরিশ্রমই যথেষ্ট নয়, বরং বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের সাথে কাজ করতে হবে। যেমন পেঁচা সম্পূর্ণ অন্ধকারেও কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে, তেমনি মানুষকেও জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে দক্ষতার সাথে কাজ করতে হবে।
সারাংশে বলা যায়, পেঁচা লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দক্ষতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক। এটি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে প্রকৃত সম্পদ শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আভ্যন্তরীণ গুণাবলীর মধ্যেও নিহিত। লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে পেঁচা মানুষকে সঠিক পথে চলতে, বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করতে এবং জীবনের সকল পরিস্থিতিতে সফল হতে অনুপ্রাণিত করে।