গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথা হয় কেন- গর্ভাবস্থায় শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়, যার মধ্যে তলপেটে ব্যথা একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা। একজন গাইনোকোলজিস্ট হিসেবে আমি লক্ষ্য করেছি যে অনেক গর্ভবতী মহিলাই এই সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হন। আসুন জেনে নেই, গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথা কেন হয় এবং কীভাবে এটি মোকাবেলা করা যায়।
গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথার প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে জরায়ুর বৃদ্ধি ও স্থানান্তর। গর্ভাবস্থার প্রগতির সাথে সাথে জরায়ু ক্রমশ বড় হয়ে ওঠে, যা আশপাশের অঙ্গ ও টিস্যুতে চাপ সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়ায় লিগামেন্টগুলিতে টান পড়ে, যা তলপেটে ব্যথার অনুভূতি তৈরি করতে পারে।
হরমোনাল পরিবর্তনও এই ব্যথার কারণ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় রিল্যাক্সিন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা পেলভিক অঞ্চলের লিগামেন্ট ও জয়েন্টগুলিকে নরম করে। এটি শরীরকে প্রসবের জন্য প্রস্তুত করলেও, এর ফলে অস্থিরতা ও ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
প্রথম ত্রৈমাসিকে, গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথা কেন হয় তার একটি প্রধান কারণ হল ইম্প্ল্যান্টেশন ক্র্যাম্প। এটি ঘটে যখন নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর দেওয়ালে আটকে যায়, যা সাধারণত গর্ভধারণের ৬-১২ দিন পরে ঘটে। এই সময় হালকা রক্তপাতও হতে পারে, যাকে ইম্প্ল্যান্টেশন ব্লিডিং বলে।
এক্টপিক গর্ভধারণও প্রথম ত্রৈমাসিকে তলপেটে তীব্র ব্যথার কারণ হতে পারে। এটি একটি জরুরি অবস্থা যেখানে ভ্রূণ জরায়ুর বাইরে, সাধারণত ফ্যালোপিয়ান টিউবে বৃদ্ধি পায়। এক্টপিক গর্ভধারণের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে একপাশে তীব্র পেটব্যথা, কাঁধে ব্যথা, এবং হালকা রক্তপাত।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে, ব্রাক্সটন হিকস সংকোচন একটি সাধারণ কারণ। এগুলি হল জরায়ুর অনিয়মিত, হালকা সংকোচন যা শরীরকে প্রসবের জন্য প্রস্তুত করে। এগুলি সাধারণত অস্বস্তিকর কিন্তু ব্যথাদায়ক নয়।
রাউন্ড লিগামেন্ট ব্যথা গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক থেকে শুরু হতে পারে। জরায়ুকে সমর্থন করা লিগামেন্টগুলি টান পড়ার কারণে এই ব্যথা হয়। এটি সাধারণত তীক্ষ্ণ বা চিড়িক মারা ব্যথা হিসেবে অনুভূত হয়, বিশেষত হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তনের সময়।
পেলভিক গার্ডল ব্যথা গর্ভাবস্থার শেষের দিকে বেশি দেখা যায়। এটি পেলভিক জয়েন্টগুলি নরম হওয়া এবং বাড়তি ওজনের কারণে হতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত কোমরের নিচে, পিঠের নিচে বা নিতম্বে অনুভূত হয়।
গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথা কেন হয় তার আরও কিছু কারণ রয়েছে যা গর্ভাবস্থার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। কোষ্ঠকাঠিন্য একটি সাধারণ সমস্যা, যা হরমোনাল পরিবর্তন এবং জরায়ুর চাপের কারণে হতে পারে। এটি পেটে ব্যথা ও অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।
মূত্রনালীর সংক্রমণ (UTI) গর্ভাবস্থায় বেশি দেখা যায়। এটি তলপেটে ব্যথা, জ্বালাপোড়া সহ প্রস্রাব করা, এবং ঘন ঘন প্রস্রাবের তাগিদা সৃষ্টি করতে পারে। UTI-এর চিকিৎসা করা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি জটিল হলে প্রিটার্ম লেবারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
পেটে গ্যাস জমা থাকাও অস্বস্তি ও ব্যথার কারণ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে পাচনতন্ত্র ধীর হয়ে যেতে পারে, যা গ্যাস ও ব্লোটিং বাড়িয়ে তোলে।
যদিও অনেক ক্ষেত্রেই গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথা স্বাভাবিক, কিছু পরিস্থিতিতে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন:
১. তীব্র ব্যথা: যদি ব্যথা তীব্র হয় বা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
২. রক্তপাত: কোনও ধরনের রক্তপাত, বিশেষত যদি তা ব্যথার সাথে যুক্ত হয়।
৩. জ্বর: ১০০.৪°F (৩৮°C) বা তার বেশি তাপমাত্রা।
৪. প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া বা রক্ত: এগুলি UTI-এর লক্ষণ হতে পারে।
৫. বমি: যদি ব্যথার সাথে তীব্র বমি থাকে। ৬. ভ্রূণের নড়াচড়া কমে যাওয়া।
১. বিশ্রাম ও অবস্থান পরিবর্তন: পাশ ফিরে শোওয়া বা বালিশ দিয়ে পা তুলে রাখা সাহায্য করতে পারে।
২. হালকা ব্যায়াম: নিয়মিত হাঁটা বা সাঁতার কাটা রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় ও ব্যথা কমাতে পারে।
৩. গরম/ঠান্ডা কম্প্রেস: ব্যথার জায়গায় গরম বা ঠান্ডা কম্প্রেস দেওয়া যেতে পারে।
৪. যোগব্যায়াম: প্রিনাটাল যোগা পেশী শক্তিশালী করতে এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
৫. সঠিক পুষ্টি: পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথা একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তনের ফলাফল। তবে, কোনও উদ্বেগজনক লক্ষণ দেখা দিলে তা অবহেলা করা উচিত নয়। নিয়মিত প্রিনাটাল চেকআপ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন একটি সুস্থ গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
সূত্র:
মন্তব্য করুন