LinkedIn AI tool failure: আজকের ডিজিটাল যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোও এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্যবহারকারীদের আরও ভালো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু লিংকডইনের ক্ষেত্রে একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেশাদার নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম লিংকডইনের AI Writing Assistant টুলটি প্রত্যাশিত জনপ্রিয়তা পায়নি। কোম্পানির নিজেরই সিইও রায়ান রসলানস্কি স্বীকার করেছেন যে এই ফিচারটি তাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম জনপ্রিয় হয়েছে। আসুন জেনে নিই এর পেছনের কারণগুলো কী এবং এটি আমাদের পেশাদার জীবনে কী প্রভাব ফেলতে পারে।
লিংকডইনের AI Writing Assistant কী এবং কীভাবে কাজ করে
লিংকডইনের AI Writing Assistant হলো একটি বিশেষ টুল যা ব্যবহারকারীদের পোস্ট লেখার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। এই টুলটি সম্পূর্ণ নতুন কন্টেন্ট তৈরি করে না, বরং ব্যবহারকারী যে পোস্ট লিখেছেন সেটিকে আরও উন্নত করার পরামর্শ দেয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, আপনি যখন কোনো পোস্ট লিখবেন, তখন এই টুলটি আপনাকে সেই লেখাটি আরও পেশাদার এবং আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বিভিন্ন সাজেশন দেবে।
এই টুলটির মূল উদ্দেশ্য ছিল পেশাদারদের কন্টেন্ট তৈরির প্রক্রিয়াকে সহজ করা এবং তাদের পোস্টগুলোকে আরও কার্যকর করে তোলা। বিশেষত যারা লেখালেখিতে খুব একটা দক্ষ নন, তাদের জন্য এই ফিচারটি একটি সহায়ক হিসেবে কাজ করার কথা ছিল।
প্রত্যাশিত জনপ্রিয়তা পায়নি কেন
লিংকডইনের সিইও রায়ান রসলানস্কি ব্লুমবার্গের সাথে এক সাক্ষাত্কারে খোলাখুলি স্বীকার করেছেন যে তাদের AI Writing Assistant টুল প্রত্যাশিত জনপ্রিয়তা পায়নি। তার ভাষায়, “সত্যি কথা বলতে কি, এটি আমার ভাবনার মতো জনপ্রিয় হয়নি।” এই স্বীকারোক্তি থেকে বোঝা যায় যে কোম্পানি এই টুলটি নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিল।
রসলানস্কির মতে, এই কম জনপ্রিয়তার পেছনে মূল কারণ হলো লিংকডইনের বিশেষ প্রকৃতি। তিনি বলেছেন, “লিংকডইন মূলত আপনার অনলাইন রিজিউমে।” এই কথার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে লিংকডইনে পোস্ট করার ক্ষেত্রে মানুষ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক থাকে।
পেশাদার সুনামের ভয়
লিংকডইনে AI ব্যবহার করে পোস্ট তৈরি না করার সবচেয়ে বড় কারণ হলো পেশাদার সুনামের প্রশ্ন। রসলানস্কি এই বিষয়টি খুব স্পষ্ট করে বলেছেন: “এক্স বা টিকটকে আপনাকে সমালোচনা করা হলে সেটা এক ব্যাপার। কিন্তু লিংকডইনে সমালোচিত হলে সেটা সত্যিই আপনার অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরির ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।”
এই কথার মাধ্যমে তিনি যে বিষয়টি তুলে ধরেছেন সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লিংকডইন একটি পেশাদার প্ল্যাটফর্ম যেখানে আপনার প্রতিটি পোস্ট আপনার ক্যারিয়ারের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। নিয়োগদাতারা, সহকর্মীরা এবং ব্যবসায়িক অংশীদাররা আপনার পোস্টগুলো দেখেন এবং সেগুলোর ভিত্তিতে আপনার সম্পর্কে মতামত তৈরি করেন।
সত্যতা এবং ব্যক্তিত্বের প্রশ্ন
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো সত্যতার প্রশ্ন। পেশাদার পরিবেশে মানুষ চান যে তাদের কন্টেন্ট তাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব এবং চিন্তাভাবনা প্রকাশ করুক। AI দিয়ে তৈরি কন্টেন্ট অনেক সময় জেনেরিক এবং ব্যক্তিত্বহীন মনে হয়। যেহেতু লিংকডইনে ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই মানুষ এমন কিছু পোস্ট করতে চান না যা তাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর প্রকাশ করে না।
অনেক ব্যবহারকারী মনে করেন যে AI দিয়ে তৈরি কন্টেন্ট সহজেই চেনা যায় এবং এটি তাদের পেশাদার ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তারা ভয় পান যে অন্যরা তাদের অলস বা অসৎ হিসেবে ভাবতে পারে।
AI দক্ষতার চাহিদা বনাম AI টুল ব্যবহারের দ্বিধা
আকর্ষণীয় বিষয় হলো, যদিও লিংকডইনের AI Writing Assistant জনপ্রিয় হয়নি, কিন্তু AI সংক্রান্ত দক্ষতার চাহিদা এবং আগ্রহ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে AI সংক্রান্ত দক্ষতার প্রয়োজন রয়েছে এমন চাকরির পোস্ট ছয়গুণ বেড়েছে। একই সময়ে, ব্যবহারকারীরা তাদের প্রোফাইলে AI সংক্রান্ত দক্ষতা যোগ করার হার বেড়েছে বিশগুণ।
এই পরিসংখ্যান একটি আকর্ষণীয় বৈপরীত্য তৈরি করে। একদিকে মানুষ AI দক্ষতা শিখতে এবং তাদের প্রোফাইলে তা দেখাতে আগ্রহী, কিন্তু অন্যদিকে তারা সরাসরি AI টুল ব্যবহার করে কন্টেন্ট তৈরি করতে দ্বিধাবোধ করছেন। এটি দেখায় যে AI সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি জটিল এবং প্রসঙ্গ নির্ভর।
গোপনে AI ব্যবহারের প্রবণতা
মজার বিষয় হলো, অনেকেই আসলে AI ব্যবহার করেন কিন্তু তা গোপনে। স্বয়ং লিংকডইনের সিইও রায়ান রসলানস্কি স্বীকার করেছেন যে তিনি মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলাকে ইমেইল পাঠানোর আগে Copilot ব্যবহার করেন যাতে তার ইমেইল আরও পেশাদার শোনায়।
এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে AI টুলগুলো আসলে কার্যকর এবং মানুষ সেগুলো ব্যবহার করেন, কিন্তু তারা এটি প্রকাশ্যে করতে চান না। বিশেষত পেশাদার পরিবেশে, যেখানে সত্যতা এবং দক্ষতার প্রশ্ন জড়িত।
প্রযুক্তিগত এবং ব্যবহারিক চ্যালেঞ্জ
AI Writing Assistant এর কম জনপ্রিয়তার পেছনে কিছু প্রযুক্তিগত এবং ব্যবহারিক কারণও রয়েছে। অনেক ব্যবহারকারী অভিযোগ করেছেন যে টুলটি তাদের প্রোফাইলের বিবরণ এবং ব্যক্তিগত তথ্য সঠিকভাবে বিবেচনা করে না। ফলে যে সাজেশনগুলো আসে সেগুলো অনেক সময় জেনেরিক এবং প্রাসঙ্গিক নয়।
আরেকটি সমস্যা হলো টুলটির গতি এবং কার্যক্ষমতা। যদি টুলটি ধীরগতিতে কাজ করে বা পোস্টিং প্রক্রিয়ায় বিলম্ব ঘটায়, তাহলে ব্যস্ত পেশাদাররা সেটি ব্যবহার করতে আগ্রহী হবেন না।
ইউজার ইন্টারফেসের জটিলতা
টুলটির ব্যবহার যদি জটিল হয় বা লিংকডইনের মূল ইন্টারফেসের সাথে সঠিকভাবে মিশে না যায়, তাহলে ব্যবহারকারীরা সেটি এড়িয়ে চলবেন। একটি কার্যকর AI টুল হতে হলে সেটি অবশ্যই সহজ, দ্রুত এবং স্বজ্ঞাত হতে হবে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা এবং শিক্ষা
লিংকডইনের AI Writing Assistant এর এই অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়। প্রথমত, AI টুল তৈরি করার সময় প্ল্যাটফর্মের বিশেষ প্রকৃতি এবং ব্যবহারকারীদের মানসিকতা বিবেচনা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যবহারকারীদের সত্যতা এবং ব্যক্তিত্ব প্রকাশের চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
রসলানস্কি জানিয়েছেন যে তারা এই প্রতিক্রিয়া থেকে শিখছেন এবং ভবিষ্যতে আরও উন্নত ভার্সন তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। তারা এমন বৈশিষ্ট্য যোগ করার কথা ভাবছেন যা ব্যবহারকারীর ব্যক্তিত্ব এবং লেখার ধরন আরও ভালোভাবে প্রকাশ করবে।
ভারতীয় প্রেক্ষাপটে প্রভাব
ভারতের মতো দেশে যেখানে পেশাদার নেটওয়ার্কিং এবং ক্যারিয়ার গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, লিংকডইনের এই অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। ভারতীয় পেশাদাররা সাধারণত তাদের অনলাইন উপস্থিতি নিয়ে খুবই সচেতন এবং তারা এমন কিছু করতে চান না যা তাদের পেশাদার ভাবমূর্তিতে আঘাত হানতে পারে।
ভারতে যেহেতু প্রতিযোগিতা অত্যন্ত তীব্র এবং চাকরির বাজার চ্যালেঞ্জিং, তাই প্রত্যেকে চান যে তাদের লিংকডইন প্রোফাইল এবং পোস্টগুলো সর্বোচ্চ মানের হোক। এই পরিস্থিতিতে AI টুল ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হতে পারে।
লিংকডইনের AI Writing Assistant এর কম জনপ্রিয়তা AI প্রযুক্তির ব্যর্থতার পরিবর্তে বরং ব্যবহারকারীদের বিচক্ষণতার প্রমাণ। এটি দেখায় যে মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করে এবং নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে এর মানে এই নয় যে AI প্রযুক্তির কোনো ভবিষ্যৎ নেই পেশাদার কন্টেন্ট তৈরিতে। বরং এটি নির্দেশ করে যে AI টুলগুলোকে আরও বুদ্ধিমান, ব্যক্তিত্বপূর্ণ এবং প্রসঙ্গ-সচেতন হতে হবে। ভবিষ্যতের AI টুলগুলো হয়তো ব্যবহারকারীর লেখার ধরন, পেশাগত ব্যাকগ্রাউন্ড এবং ব্যক্তিত্ব আরও গভীরভাবে বুঝতে পারবে এবং সেই অনুযায়ী পরামর্শ দিতে পারবে।
লিংকডইনের AI Writing Assistant টুলটি প্রত্যাশিত জনপ্রিয়তা না পেলেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল। এই অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া শিক্ষা ভবিষ্যতে আরও ভালো এবং ব্যবহারকারী-বান্ধব AI টুল তৈরিতে সহায়ক হবে। পেশাদার জগতে AI প্রযুক্তির সফল প্রয়োগের জন্য শুধু প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাই যথেষ্ট নয়, বরং ব্যবহারকারীদের মানসিকতা, প্রয়োজন এবং উদ্বেগগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
