Why Madhusudan Gupta is memorable: আধুনিক ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাঁরা সমাজের কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা নিশ্চিত করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত। মধুসূদন গুপ্ত স্মরণীয় কেন – এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা মানেই ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সাথে পরিচিত হওয়া। তিনি শুধুমাত্র একজন চিকিৎসক ছিলেন না, বরং ছিলেন এক সাহসী সংস্কারক যিনি ভারতে প্রথম মানব শবব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে আধুনিক চিকিৎসাশিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
জন্ম ও প্রাথমিক পরিচয়: একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান
১৮০০ সালে হুগলি জেলার বৈদ্যবাটি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মধুসূদন গুপ্ত। তাঁর পরিবার ছিল আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ। তাঁর প্রপিতামহ বক্সী উপাধি পেয়েছিলেন এবং পিতামহ ছিলেন হুগলির নবাব পরিবারের গৃহচিকিৎসক। এমন একটি চিকিৎসক পরিবারে জন্ম নিলেও ছোটবেলায় মধুসূদন গুপ্ত ছিলেন অত্যন্ত দুরন্ত প্রকৃতির এবং প্রথাগত শিক্ষায় অনাগ্রহী। এমনকি তাঁর পিতা একসময় তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন পড়াশোনায় অমনোযোগের কারণে।
তবে পরবর্তীতে তিনি ডেভিড হেয়ারের পটলডাঙ্গা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং পরে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা নিয়ে অধ্যয়ন করেন। এখানেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় যখন তিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার সাথে পরিচিত হন।
মধুসূদন গুপ্ত স্মরণীয় কেন: প্রথম শবব্যবচ্ছেদের ঐতিহাসিক মুহূর্ত
মধুসূদন গুপ্ত স্মরণীয় কেন – এই প্রশ্নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর লুকিয়ে আছে ১৮৩৬ সালের ১০ জানুয়ারির এক ঐতিহাসিক ঘটনায়। এদিন কলকাতা মেডিকেল কলেজে তিনি ভারতে প্রথম মানব শবব্যবচ্ছেদ সম্পন্ন করেন। এটি ছিল সুশ্রুতের প্রায় ৩,০০০ বছর পরে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম আনুষ্ঠানিক শবব্যবচ্ছেদ।
ডাক্তার হেনরি গুডইভের তত্ত্বাবধানে এই ঐতিহাসিক কাজটি সম্পন্ন করতে তাঁর সহায়তা করেছিলেন চারজন সাহসী ছাত্র – উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীনচন্দ্র মিত্র। এই ঘটনা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ৫০টি তোপধ্বনি করে এর সম্মান জানানো হয়েছিল।
ধর্মীয় কুসংস্কার ভাঙার সাহসী পদক্ষেপ
সেই সময়ে হিন্দু সমাজে মৃতদেহ স্পর্শ করাকে অপবিত্র ও ধর্মহীনতার কাজ বলে মনে করা হতো। বিশেষত একজন উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ হিসেবে মধুসূদন গুপ্তের পক্ষে এই কাজ করা ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসিক। তিনি রক্ষণশীল সমাজের তীব্র বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিজ্ঞানের স্বার্থে এগিয়ে এসেছিলেন।
শবব্যবচ্ছেদের পর রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাঁকে জাতিচ্যুত করার হুমকি দেয়। কিন্তু মধুসূদন গুপ্ত তাঁর গভীর সংস্কৃত জ্ঞান দিয়ে এই বিরোধিতার জবাব দেন। তিনি প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে প্রমাণ করেন যে শবব্যবচ্ছেদ প্রাচীন ভারতেও প্রচলিত ছিল।
কলমের যোদ্ধা: হুমায়ুন আজাদের সাহসী লেখনী যেভাবে নাড়া দিয়েছিল বাংলা সাহিত্যকে
চিকিৎসাবিজ্ঞানে যুগান্তকারী অবদান ও পেশাগত জীবন
কলকাতা মেডিকেল কলেজে দীর্ঘ কর্মজীবন
১৮৩৫ সালে মধুসূদন গুপ্ত কলকাতা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। ১৮৪৩-৪৪ সালে যখন মেডিকেল কলেজের হিন্দুস্থানী বিভাগ নতুনভাবে গড়ে তোলা হয়, তখন তাঁকে সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৮৫২ সালে বাংলা বিভাগ খোলা হলে সেটারও দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয়। আমৃত্যু দীর্ঘ ২২ বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন।
অনুবাদ কর্ম ও গবেষণা
মধুসূদন গুপ্ত শুধু চিকিৎসক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ অনুবাদকও। তিনি হুপারের ‘অ্যানাটমিস্ট ভেদ-মেকাম’ সহ বেশ কয়েকটি ইংরেজি চিকিৎসা গ্রন্থ সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। ১৮৪৫ সালে তিনি লন্ডন ফার্মাকোপিয়ার অনুবাদ সম্পন্ন করেন, যা ১৮৪৯ সালে “লণ্ডন ফার্ম্মাকোপিয়া/অর্থাৎ/ইংলন্ডীয় ঔষধ কল্পাবলী” নামে প্রকাশিত হয়।
তিনি বয়ঃসন্ধি সম্পর্কে গবেষণাও করেছিলেন এবং ভারতীয় ও ব্রিটিশ নারীদের রজঃদর্শনের পার্থক্য সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে সহায়তা করেছিলেন।
সামাজিক সংস্কার ও জনস্বাস্থ্যে অবদান
মধুসূদন গুপ্ত শুধু চিকিৎসাক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। ১৮৩৭ সালে তিনি ফিভার হাসপাতাল ও মিউনিসিপ্যাল ইমপ্রুভমেন্টের জেনারেল কমিটির সাথে যুক্ত হয়ে কলকাতার স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি, মাতৃস্বাস্থ্যসেবার উন্নতি এবং গুটিবসন্তের টিকাকরণ কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তাঁর কাজের ফলে ১৮৩৭ থেকে ১৮৪৪ সালের মধ্যে কলকাতা মেডিকেল কলেজে শবব্যবচ্ছেদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৮৩৭ সালে যেখানে ৬০টি মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল, ১৮৪৪ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০টিরও বেশি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ও উত্তরাধিকার
আধুনিক চিকিৎসাশিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর
মধুসূদন গুপ্তের শবব্যবচ্ছেদ ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক নতুন যুগের সূচনা করে। তাঁর এই সাহসী পদক্ষেপের ফলে ভারতে আধুনিক অ্যানাটমি বা শারীরস্থানবিদ্যার চর্চা শুরু হয়। এটি ছিল পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার সাথে ভারতীয় ঐতিহ্যের এক সফল সমন্বয়।
সামাজিক বাধা ভাঙার পথপ্রদর্শক
তাঁর কাজ শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনে সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। তাঁর এই দৃষ্টান্ত পরবর্তী প্রজন্মের চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
সিঁদুর হাত থেকে পড়ে গেলে কী হয়? জেনে নিন এর তাৎপর্য ও প্রভাব
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মাননা
মধুসূদন গুপ্তের কাজ শুধু ভারতেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বীকৃতি পেয়েছে। ব্রিটেনেও তাঁর এই কীর্তি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার বিজয় হিসেবে দেখা হয়েছিল। কয়েক বছর পর কলকাতা মেডিকেল কলেজে তাঁর একটি প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়, যা আজও সেখানে রয়েছে।
আধুনিক সময়ে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত মেমোরিয়াল লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০০৮ সালে ডাক্তার এ. কে. দত্ত এই পুরস্কারে ভূষিত হন।
জীবনাবসান ও চিরন্তন স্মৃতি
১৮৫৬ সালের ১৫ নভেম্বর ডায়াবেটিক সেপটিসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মধুসূদন গুপ্ত পরলোকগমন করেন। তিনি মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু তাঁর কীর্তি আজও ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানে অমর হয়ে আছে।
মধুসূদন গুপ্ত স্মরণীয় কেন – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে তিনি শুধু একজন চিকিৎসক ছিলেন না, বরং ছিলেন একজন যুগস্রষ্টা। তাঁর সাহসী পদক্ষেপের ফলেই ভারতে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভিত্তি রচিত হয়েছে। সামাজিক কুসংস্কার ভেঙে বিজ্ঞানের পথে এগিয়ে যাওয়ার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের শেখায় যে সত্যিকারের অগ্রগতি তখনই সম্ভব যখন আমরা পুরাতন কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেঙে নতুন চিন্তাধারাকে স্বাগত জানাই।