Why is Soap Foam Always White, Regardless of the Soap’s Color: আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাবান এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ল্যাভেন্ডারের বেগুনি, লেবুর হলুদ বা গোলাপের গোলাপি—নানা রঙ ও সুগন্ধের সাবান আমাদের মোহিত করে। কিন্তু একটা বিষয় কি কখনো খেয়াল করেছেন? সাবান যে রঙেরই হোক না কেন, তার থেকে তৈরি হওয়া ফেনা কিন্তু সবসময় ধবধবে সাদা। এই সাধারণ অথচ অবাক করা ঘটনার পেছনে লুকিয়ে আছে এক দারুণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, যা মূলত আলোকরশ্মির প্রতিফলন এবং প্রতিসরণের এক জটিল খেলা। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা “Scientific American” এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT)-র মতো প্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুযায়ী, সাবানের ফেনা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বুদবুদের সমষ্টি, যা আলোর সমস্ত রঙকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়, ফলে আমাদের চোখে তা সাদা দেখায়।
এই ঘটনার মূলে রয়েছে আলোর প্রকৃতি এবং ফেনায় তার আচরণের এক অদ্ভুত রসায়ন। যখন আমরা সাবান জলে গুলে ফেনা তৈরি করি, তখন অসংখ্য পাতলা জলের স্তর দিয়ে তৈরি লক্ষ লক্ষ ছোট বুদবুদ জন্মায়। এই বুদবুদগুলোর পাতলা আস্তরণে আলোকরশ্মি যখন এসে পড়ে, তখন তা একসঙ্গে একাধিকবার প্রতিসরণ (refraction) ও প্রতিফলন (reflection) ঘটায়। আলোর এই এলোমেলো বিক্ষেপণের (scattering) কারণেই আমাদের চোখ কোনো নির্দিষ্ট রঙ দেখতে পায় না। বরং, আলোর বর্ণালীর সবকটি রঙ— বেগুনী, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা এবং লাল (বেনীআসহকলা) — একত্রিত হয়ে সাদা রঙ তৈরি করে। এই প্রক্রিয়াটি “Mie scattering” নামে পরিচিত, যা ঘটে যখন কোনো কণার আকার আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সমান বা তার চেয়ে বড় হয়। সাবানের ফেনার বুদবুদগুলোর ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটে, তাই রঙিন সাবান সত্ত্বেও ফেনা সাদা হয়।
ফেনা কেন এবং কীভাবে তৈরি হয়?
ফেনা তৈরির প্রক্রিয়া বুঝতে হলে আগে আমাদের সাবানের অণুর গঠন সম্পর্কে জানতে হবে। প্রতিটি সাবানের অণুর দুটি প্রধান অংশ থাকে—একটি ‘মাথা’ এবং একটি ‘লেজ’।
- হাইড্রোফিলিক (Hydrophilic) মাথা: এই অংশটি জলকে আকর্ষণ করে (water-loving)।
- হাইড্রোফোবিক (Hydrophobic) লেজ: এই অংশটি জল থেকে বিকর্ষিত হয় কিন্তু তেল বা গ্রিজের মতো পদার্থকে আকর্ষণ করে (water-hating)।
যখন সাবান জলে মেশানো হয়, তখন এর হাইড্রোফোবিক লেজগুলো জল থেকে দূরে থাকতে চায় এবং বাতাসের দিকে আকৃষ্ট হয়। ফলে, জলের পৃষ্ঠতলে একটি পাতলা স্তর তৈরি হয়। যখন আমরা হাত দিয়ে ঘষি বা জল আলোড়িত করি, তখন এই প্রক্রিয়ায় বাতাস আটকে গিয়ে ছোট ছোট বুদবুদ তৈরি হতে শুরু করে। সাবানের অণুগুলো এই বুদবুদগুলোকে ঘিরে একটি পাতলা স্তর বা ফিল্ম তৈরি করে, যা জল এবং বাতাসের মধ্যে একটি স্থিতিশীল কাঠামো প্রদান করে। এই লক্ষ লক্ষ বুদবুদের সমষ্টিই হলো ফেনা।
আলোর খেলা: ফেনাকে সাদা দেখানোর মূল কারণ
আলোর প্রকৃতি এবং তার আচরণই সাবানের ফেনার সাদা রঙের প্রধান কারণ। সূর্যালোক বা আমাদের বাড়ির লাইটের আলোকরশ্মি আসলে কোনো একক রঙের নয়, এটি বিভিন্ন রঙের আলোর মিশ্রণ। প্রিজমের মধ্যে দিয়ে গেলে যেমন আলোর সাতটি রঙ দেখা যায়, সাবানের ফেনাতেও ঠিক তেমনই আলোর এক জটিল খেলা চলে।
আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ
যখন আলোকরশ্মি এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে প্রবেশ করে, তখন তার গতিপথ পরিবর্তিত হয়। একেই প্রতিসরণ বলা হয়। আবার, আলো যখন কোনো পৃষ্ঠে বাধা পেয়ে ফিরে আসে, তখন তাকে প্রতিফলন বলে। সাবানের ফেনা হলো জল, বাতাস এবং সাবানের অণুর এক জটিল মিশ্রণ।
- ফেনার প্রতিটি বুদবুদ একটি পাতলা জলের স্তর দিয়ে আবৃত থাকে।
- আলোকরশ্মি যখন এই বুদবুদের গায়ে এসে পড়ে, তখন এটি প্রথমে বাতাস থেকে জলের স্তরে প্রবেশ করে (প্রতিসরণ ঘটে)।
- এরপর জলের স্তরের ভেতরের দেওয়ালে লেগে তা আবার প্রতিফলিত হয়ে বাইরের দিকে বেরিয়ে আসে।
এই প্রক্রিয়াটি একবার নয়, লক্ষ লক্ষ বুদবুদের মধ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন বার ঘটতে থাকে। ফলে আলোকরশ্মি কোনো নির্দিষ্ট দিকে না গিয়ে চারদিকে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
বিক্ষেপণ (Scattering)
আলোর এই এলোমেলো ছড়িয়ে পড়াকেই বলা হয় বিক্ষেপণ বা স্ক্যাটারিং। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT)-র পদার্থবিদ্যা বিভাগের একটি গবেষণাপত্র অনুযায়ী, যখন কোনো বস্তুর উপাদানগুলোর আকার আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে অনেক বড় হয়, তখন সেখানে “Mie scattering” ঘটে। সাবানের ফেনার বুদবুদগুলোর আকার যথেষ্ট বড় হওয়ায় আলোর সমস্ত রঙ—লাল, নীল, সবুজ ইত্যাদি—প্রায় সমানভাবে বিক্ষিপ্ত হয়। যখন আমাদের চোখে এই সমস্ত রঙের আলোকরশ্মি একসঙ্গে এসে পৌঁছায়, তখন আমাদের মস্তিষ্ক সেটিকে সাদা হিসেবে উপলব্ধি করে।
একই কারণে আমরা মেঘ বা দুধকে সাদা দেখি। মেঘ হলো অসংখ্য ছোট ছোট জলকণার সমষ্টি এবং দুধ হলো ফ্যাটের ক্ষুদ্র কণার মিশ্রণ। উভয় ক্ষেত্রেই আলোর বিক্ষেপণ ঘটে, যার ফলে তা সাদা দেখায়।
রঙিন সাবানের রঙ কোথায় যায়?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, যদি আলোর বিক্ষেপণের কারণেই ফেনা সাদা হয়, তাহলে সাবানে মেশানো রঙটি কোথায় উধাও হয়ে যায়?
এর উত্তর হলো—রঙটি আসলে উধাও হয় না, কিন্তু তার ঘনত্ব (concentration) অত্যন্ত কমে যায়। যখন আমরা ফেনা তৈরি করি, তখন খুব সামান্য পরিমাণ সাবান প্রচুর পরিমাণে জল এবং বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে, সাবানের রঙ সৃষ্টিকারী কণাগুলো (pigments) এতটাই পাতলা হয়ে যায় যে তা আর আলোর ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।
উদাহরণস্বরূপ, এক বালতি জলে যদি এক ফোঁটা নীল রঙ মেশানো হয়, তাহলে জলটি হালকা নীল দেখাবে। কিন্তু যদি সেই জল থেকে একটি ছোট ফোঁটা তুলে নেওয়া হয়, তবে তাকে প্রায় বর্ণহীন মনে হবে। সাবানের ফেনার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। প্রতিটি বুদবুদের পাতলা আস্তরণে রঙের কণার পরিমাণ এতটাই নগণ্য থাকে যে তা আলোর রঙকে প্রভাবিত করতে পারে না। ফলে, আলোর প্রাকৃতিক ধর্ম অনুযায়ী বিক্ষেপণের কারণে ফেনা সাদাই দেখায়।
পরিসংখ্যানে বিষয়টি বোঝা যাক
- একটি সাধারণ সাবানের বুদবুদের দেওয়ালের পুরুত্ব প্রায় ৫০ থেকে ১০০০ ন্যানোমিটার (nanometer) পর্যন্ত হতে পারে। [Source: American Physical Society]
- সাবানে ব্যবহৃত রঙের কণার ঘনত্ব ফেনায় এতটাই কমে যায় যে প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে রঙের অণুর সংখ্যা প্রায় কয়েক হাজারে নেমে আসে, যা আলোর রঙ পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট নয়।
- বাতাস, জল এবং সাবানের অনুপাতের একটি সাধারণ হিসাব অনুযায়ী, ফেনায় প্রায় ৯৫% বাতাস, ৪.৯% জল এবং মাত্র ০.১% সাবান থাকে। এই বিপুল পরিমাণ জল এবং বাতাসের মিশ্রণে সাবানের রঙ তার প্রভাব হারিয়ে ফেলে।
কিছু সাধারণ উদাহরণ যা বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করবে
প্রকৃতিতে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে মূল উপাদান রঙিন হলেও তার সূক্ষ্ম রূপটি সাদা দেখায়।
- বরফ: স্বচ্ছ জল জমে বরফ তৈরি হলেও, যখন বরফকে গুঁড়ো করা হয়, তখন তা সাদা দেখায়। কারণ গুঁড়ো বরফের অসংখ্য ক্ষুদ্র কণা আলোকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়।
- চিনি বা লবণ: চিনির দানা স্বচ্ছ হলেও যখন তাকে গুঁড়ো করা হয়, তখন তা সাদা দেখায়।
- কাগজ: কাগজ তৈরি হয় গাছের পাল্প থেকে যার রঙ বাদামী। কিন্তু প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে যখন এর থেকে লিগনিন সরিয়ে দেওয়া হয় এবং ফাইবারগুলোকে আলাদা করা হয়, তখন আলোর বিক্ষেপণের কারণে তা সাদা হয়ে ওঠে।
এই সমস্ত উদাহরণের পেছনে মূল বিজ্ঞানটি একই—আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ এবং বিক্ষেপণের সম্মিলিত প্রভাব।
টেবিল: রঙিন সাবান ও সাদা ফেনার মূল পার্থক্য
বৈশিষ্ট্য | রঙিন সাবান (বার) | সাদা ফেনা (বুদবুদ) |
গঠন | সাবানের অণু, রঙ এবং অন্যান্য উপাদানগুলি ঘন সন্নিবিষ্ট অবস্থায় থাকে। | জল, বাতাস এবং সাবানের অণুর পাতলা স্তরের অসংখ্য বুদবুদ। |
আলোর আচরণ | আলো সাবানের পৃষ্ঠ থেকে একটি নির্দিষ্ট রঙ শোষণ করে বাকিটা প্রতিফলিত করে, তাই আমরা সাবানের রঙ দেখতে পাই। | আলোকরশ্মি লক্ষ লক্ষ বুদবুদের পৃষ্ঠে বহুবার প্রতিফলিত ও প্রতিসৃত হয়ে চারদিকে বিক্ষিপ্ত হয়। |
রঙের ঘনত্ব | রঙের কণার ঘনত্ব অনেক বেশি থাকে। | জল এবং বাতাসের মিশ্রণে রঙের ঘনত্ব অত্যন্ত নগণ্য হয়ে যায়। |
মূল কারণ | রাসায়নিক রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতি। | আলোর বিক্ষেপণ (Mie Scattering)। |
উদাহরণ | একটি রঙিন প্লাস্টিকের টুকরো। | গুঁড়ো বরফ, দুধ, মেঘ। |
সাবান যে রঙেরই হোক না কেন, তার ফেনা সাদা হওয়ার কারণ কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন নয়, বরং এটি একটি সম্পূর্ণ আলোকীয় ঘটনা (optical phenomenon)। লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র বুদবুদের সমন্বয়ে গঠিত ফেনা আলোর জন্য একটি জটিল ধাঁধার মতো কাজ করে। আলোকরশ্মি এই বুদবুদগুলির ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় বারংবার প্রতিফলিত ও প্রতিসৃত হয়ে চারদিকে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, আলোর বর্ণালীর সবকটি রঙ আমাদের চোখে একসঙ্গে পৌঁছায়। এর ফলে আমাদের মস্তিষ্ক কোনো নির্দিষ্ট রঙ আলাদা করতে পারে না এবং ফেনাকে সাদা হিসেবেই চেনে। সাবানের মধ্যে থাকা রঙটি ফেনায় এতটাই পাতলা হয়ে যায় যে তার কোনো প্রভাবই আর অবশিষ্ট থাকে না। তাই পরের বার যখন রঙিন সাবান থেকে সাদা ফেনা বের হতে দেখবেন, তখন এর পেছনের এই সুন্দর বিজ্ঞানটিকে নিশ্চয়ই মনে করবেন।