বর্তমানে তারকা সন্তানরা জন্মের পর থেকেই সেলিব্রেটি হয়ে যান। রাজ চক্রবর্তী ও শুভশ্রী গাঙ্গুলীর ছেলে ইউভান যেমন ছোট থেকেই স্টার, জন্মের কিছু মাস যেতে না যেতেই তার অসংখ্য ভক্ত ও সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক ফ্যান পেজ তৈরি হয়ে যায়! অথচ বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে হয়েও লোক চক্ষুর অন্তরালেই থাকেন সৌগত চ্যাটার্জী ! কেন তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন?
২০২০র ১৫ ই নভেম্বর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর ঠিক চার মাস পর মারা যান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দীপা দেবী। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও দীপা দেবীর মৃত্যুর পর সবদিক সামলাতে দেখা যায় তাদের মেয়ে পৌলমী বসুকে, থিয়েটারের সুবাদে পৌলমী পরিচিত মুখ হলেও চলচ্চিত্র প্রেমীদের চেনা পরিচিতের গণ্ডির বাইরেই রয়ে গিয়েছেন সৌমিত্র পুত্র সৌগত। ১৯৬১ সালে ২৭ শে সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন সোমিত্র পুত্র সৌগত চ্যাটার্জী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করেন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি সৌগত ভালবাসতেন কবিতা চর্চা করতে, সাহিত্যের প্রতিও অদম্য একটি ঝোঁক ছিল তার। তবে কবিতা ও সাহিত্যের পাশাপাশি তার জীবনে আরও একটি আকর্ষণের জায়গা তৈরি হয়ে ছিল, সেটা সঙ্গীত। রয়েল স্কুল অফ মিউজিক লন্ডন থেকে বেহালা বাদক হিসেবে গ্রেড ৫, ৬ ও ৭ বিভাগে পাশ করেছেন তিনি। সাংবাদিকতা সূত্রে তিনি অমৃতবাজার পত্রিকার লেখক ছিলেন।
জন্ম তারিখ দিয়ে লগ্ন নির্ণয়: আপনার ভাগ্যের চাবিকাঠি খুঁজুন!
এছাড়া সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন সৌগত। তপন সিংহের অন্তর্ধান ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন তিনি। নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত অনিল চট্টোপাধ্যায় বিষয়ক তথ্য চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন সৌগত, পরবর্তীকালে একটি স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন বর্তমানে তিনি চাকরিজীবী। তিনি একজন লেখক ও বেহালা বাদক হওয়ার পাশাপাশি একজন অনুবাদকও। সৌগত চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ১৪ টি কাব্যগ্রন্থ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। কয়েক বছর আগে শুধু কবিতার জন্য নামক একটি অনুবাদ কবিতার সংকলনে অনুবাদকের দুই বন্ধুর সঙ্গে ভূমিকায় কাজ করেছিলেন সৌগত চট্টোপাধ্যায়। মৃত্যুর আগে সৌমিত্র বাবুও এই বইটি পড়েছিলেন।
এছাড়া সৌগত চ্যাটার্জী নিয়মিত বেশ কিছু প্রথম সারির বাংলা পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। ২০২০ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর বাবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৌগত চ্যাটার্জী বলেন,‘ বাবার সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত গুলির কথা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। খুব ছোটবেলায় বাবা একবার আমাকে আর বোনকে ছবি তুলতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন আমার চার থেকে পাঁচ বছর বয়স বোনের এক কিংবা দুই। কিছু ফটোগ্রাফার আমাদের সঙ্গে বাবার ছবি তুলেছিলেন। সেইসব ছবির মধ্যে কয়েকটি এখনও আমাদের কাছে রয়েছে। ওই স্মৃতিটা আজও মনের কোণে রয়েছে। মাঝেমধ্যেই বাবা আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেতেন। কখনও কাছে কখনও আবার দূরে। যখন লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে থাকতাম সেই সময় একবার ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব আর লেক ক্লাবের মাঝামাঝি যে হ্যাঙ্গিং ব্রিজ রয়েছে, সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্কুলের গ্রীষ্ম, পুজো কিংবা শীতের ছুটি পড়লেই আমরা কলকাতার বাইরে বেড়াতে যেতাম। বাবা মা আমি আর বোন চার জনই যেতাম মাঝেমধ্যে বাবার কোন বন্ধু বা আত্মীয়রাও আমাদের সঙ্গে যেতেন। আমাদের একটি অ্যাম্বাসেডের গাড়ি ছিল, সেই গাড়ি ড্রাইভ করে আমাদের নিয়ে যেতেন বাবা, সঙ্গে মাঝেমধ্যে একজন ড্রাইভার রাখতেন কিছুটা নিজে চালাতেন। কিছুটা ড্রাইভার। মধুপুর হয়ে নৈনিতাল মুসৌরি কিংবা কল্যাণপুর গিয়েছিলেন তিনি , ট্রেনে করে যে ঘুরতাম না তা নয় আসলে কলকাতার বাইরে যে ভারতবর্ষ বা পৃথিবী রয়েছে সেটা তো বাবার হাত ধরেই চিনেছি, বাবা আমাদের বেড়াতে যেতে বলতেন, এক্সকারশনে উৎসাহ দিতেন।”
সৌগত চ্যাটার্জীর অনেকখানি জুড়ে রয়েছে তার বাবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সৌগত চ্যাটার্জীর মধ্যে যে সাহিত্য বোধ বা সাহিত্য প্রীতি সেই সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা সৌগতের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিলেন সৌমিত্র চ্যাটার্জী নিজেই। তার কথায়, ’ছোটবেলা থেকেই দেখেছি বাবা অভিনয়ের পাশাপাশি প্রচুর বই পড়তেন। বড় হওয়ার পর আমাকেও প্রচুর বই দিতেন পড়ার জন্য , সেখান থেকেই লেখালেখির ইচ্ছা জাগে।’সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে তার একটা ঘরোয়া লাইব্রেরী ছিল, সেখানে বাবাকে বই পড়তে দেখেই সৌগত চ্যাটার্জীর বই পড়া শুরু, সাহিত্যের ক্ষেত্রে বাবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই তার অনুপ্রেরণা। এই প্রসঙ্গে সৌগত চ্যাটার্জী বলেন, “ ওই সেভেন কিংবা এইট থেকে আমিও সেই বইগুলো পড়তে শুরু করলাম। বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় হল। এমনকি রবীন্দ্রত্তর সাহিত্যের সঙ্গেও আমার পরিচয় এভাবেই হয়েছিল”
শব্দের জাদুকর: নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি
তবে সাহিত্য প্রীতির ক্ষেত্রে হোক , সঙ্গীতের বিষয়ে হোক অথবা চলচ্চিত্র সব ক্ষেত্রেই সৌগত চ্যাটার্জীকে উৎসাহ দিয়েছেন তার বাবা সৌমিত্র চ্যাটার্জী। কী কী ছবি দেখা উচিত সেগুলো সাজেস্ট করে দিতেন সৌমিত্র বাবু। সৌগত চ্যাটার্জী বলেছিলেন,“আমাদের বন্ডিংটা অন্যরকম ছিল। ভালো ফিল্ম দেখতে শিখিয়েছিলেন। সেই ছেলেবেলায় আমাকে আর বোনকে পথের পাঁচালী দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে অপরাজিত, অপুর সংসার দেখেছি। অভিযান, কনি দেখেছি। ত্রুফো, গদারের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন। কোনও ভালো ছবি এলে, বলতেন দেখে আসতে। শেষের দিকেও বেলাশেষে, ময়ূরাক্ষীর মতো ছবিগুলি দেখতে বলেছিলেন।”সৌগত চ্যাটার্জী যে সঙ্গীত ভালোবাসতেন তিনি যে বেহালা বাজাতেন , সেক্ষেত্রেও বরাবর তিনি তার বাবাকে পাশে পেয়েছেন, বন্ধুর মতো তার বাবা তাকে উৎসাহ দিয়েছেন।
আসলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চাননি বলেই সৌগত চ্যাটার্জী ক্যামেরা ও অ্যাকশনের থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন। আজও প্রচার বিমুখ এক নিভৃতচারী লেখক হিসেবে রয়ে গিয়েছেন সৌগত চ্যাটার্জী। এই প্রসঙ্গে সৌগত চ্যাটার্জী বলেছিলেন,“ উনি (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) ওঁর স্টারডাস্ট থেকে আমাদের দূরে রাখতেন। পর্দায় উনি হিরো। কিন্তু, বাড়িতে একেবারে ঘরোয়া। বাড়ি এবং কাজ দু’টোকে আজীবন আলাদা রেখেছেন। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার যেমন হওয়া উচিত, আমাদের পরিবারও সেরকমই ছিল।”
মন্তব্য করুন