সবকিছু থেকেও জীবন উপভোগ করতে পারছেন না? নেপথ্যের ৫টি মনস্তাত্ত্বিক কারণ ও সমাধান

why you are not enjoying life without major problems: আপনার একটি ভালো চাকরি আছে, থাকার জন্য সুন্দর একটি বাড়ি, পরিবার ও বন্ধুরা পাশে আছে এবং আপাতদৃষ্টিতে বড় কোনো সংকট নেই।…

Riddhi Datta

 

why you are not enjoying life without major problems: আপনার একটি ভালো চাকরি আছে, থাকার জন্য সুন্দর একটি বাড়ি, পরিবার ও বন্ধুরা পাশে আছে এবং আপাতদৃষ্টিতে বড় কোনো সংকট নেই। তবুও কি আপনার মনে হয় জীবনে আনন্দের অভাব? সবকিছু থেকেও যেন একটা শূন্যতা কাজ করে? যদি আপনার উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে আপনি একা নন। বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, যাকে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন ‘ল্যাঙ্গুইশিং’ (Languishing) বা জীবনের প্রতি উদাসীনতা। এটি কোনো বড় মানসিক রোগ না হলেও, জীবনের মানকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর সর্বশেষ World Mental Health Report অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, যার একটি বড় অংশই হলো বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ, যা প্রায়শই জীবন উপভোগ করতে না পারার অনুভূতি থেকে শুরু হয়। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব, কেন কোনো আপাত সমস্যা ছাড়াই মানুষ জীবন উপভোগ করতে পারে না (Why people are not enjoying life), এর পেছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো কী এবং কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা যায়।

কেন এই শূন্যতা? নেপথ্যের কারণগুলো

বাহ্যিকভাবে সবকিছু ঠিকঠাক মনে হলেও ভেতরের এই শূন্যতার পেছনে একাধিক মনস্তাত্ত্বিক এবং পারিপার্শ্বিক কারণ থাকতে পারে। চলুন, সেগুলোকে বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।

১. অ্যানহেডোনিয়া (Anhedonia): আনন্দের অনুভূতি হারিয়ে ফেলা

অ্যানহেডোনিয়া হলো এমন একটি মানসিক অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি সেই সব কাজ থেকে আনন্দ পেতে অক্ষম হন, যা তিনি আগে উপভোগ করতেন। এটি বিষণ্ণতার একটি অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলেও, কখনো কখনো এটি নিজেও একটি স্বতন্ত্র সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। যেমন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, পছন্দের সিনেমা দেখা বা নতুন কোনো জায়গায় ঘুরতে যাওয়া—এই সবকিছুই অর্থহীন এবং পানসে মনে হতে পারে। এর কারণ মস্তিষ্কের ‘রিওয়ার্ড সার্কিট’-এর কার্যকারিতা কমে যাওয়া, যা আমাদের আনন্দ, প্রেরণা এবং তৃপ্তির অনুভূতি দেয়।

২. ‘ল্যাঙ্গুইশিং’ (Languishing): স্থবিরতার অনুভূতি

সাংগঠনিক মনোবিজ্ঞানী অ্যাডাম গ্রান্ট (Adam Grant) The New York Times-এ প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধে ‘ল্যাঙ্গুইশিং’ শব্দটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এটি ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা নয়, আবার সুখী বা প্রাণবন্ত থাকাও নয়। এটি হলো এ দুয়ের মাঝখানের একটি ধূসর অবস্থা। এই অবস্থায় মানুষ লক্ষ্যহীন, স্থবির এবং অনুপ্রাণিত বোধ করে না। মনে হয় যেন জীবনটা কোনোমতে কেটে যাচ্ছে, কিন্তু এর কোনো অর্থ বা উদ্দেশ্য নেই। করোনা মহামারীর পর থেকে এই অনুভূতি অনেকের মধ্যেই বেড়েছে, কারণ দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্নতা এবং অনিশ্চয়তা আমাদের মানসিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দিয়েছে।

৩. সোশ্যাল মিডিয়ার অদৃশ্য চাপ এবং তুলনামূলক সংস্কৃতি

আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে আমাদের জীবন সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে অন্যের সাফল্যের ঝলমলে ছবি, নিখুঁত ছুটি কাটানোর মুহূর্ত বা সুখী দাম্পত্য জীবনের প্রদর্শনী দেখে নিজের জীবনকে অর্থহীন মনে হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। এই ‘তুলনামূলক সংস্কৃতি’ (Comparison Culture) আমাদের মধ্যে এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী অসন্তুষ্টি তৈরি করে। আমরা যা পেয়েছি তার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে, যা পাইনি তার জন্য আফসোস করতে শুরু করি। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন অতিরিক্ত সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটান, তাদের মধ্যে জীবন নিয়ে অসন্তুষ্টির হার প্রায় ৩০% বেশি।

৪. আধুনিক জীবনযাত্রার দৌড় এবং বার্নআউট

আধুনিক জীবনযাত্রা আমাদের একটি অন্তহীন প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ভালো ফলাফল, ভালো চাকরি, পদোন্নতি এবং আরও বেশি উপার্জনের চাপ আমাদের এতটাই ব্যস্ত রাখে যে আমরা জীবনের ছোট ছোট আনন্দগুলো উপভোগ করতে ভুলে যাই। এই ‘হাসল কালচার’ (Hustle Culture) এবং অতিরিক্ত কাজের চাপ থেকে জন্ম নেয় ‘বার্নআউট’ (Burnout)। বার্নআউট হলে শারীরিক ও মানসিক শক্তি পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়, যা জীবনকে উপভোগ করার ক্ষমতা কেড়ে নেয়।

৫. অর্থবহ সম্পর্কের অভাব

আজকের ডিজিটাল যুগে আমাদের শত শত অনলাইন বন্ধু থাকতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের অর্থবহ ও গভীর সম্পর্কের অভাব বাড়ছে। একাকিত্বের অনুভূতি কেবল একা থাকা থেকে আসে না, আসে একাত্মতার অভাব থেকেও। যখন আমরা আমাদের অনুভূতি, ভয় বা স্বপ্ন কারো সাথে মন খুলে আলোচনা করতে পারি না, তখন এক ধরনের মানসিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। হার্ভার্ডের একটি দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা অনুযায়ী, সুখী এবং দীর্ঘ জীবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অর্থবহ সম্পর্ক, অর্থ বা খ্যাতি নয়।

পরিসংখ্যান ও বিশেষজ্ঞের মত

বিশ্বের বিভিন্ন পরিসংখ্যানও এই ‘not enjoying life’ প্রবণতাকে সমর্থন করে।

  • World Happiness Report 2024 অনুযায়ী, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মানসিক সুস্থতার হার ক্রমশ কমছে। বিশেষ করে উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে তরুণরা আগের প্রজন্মের তুলনায় অসুখী।
  • Gallup-এর একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬০% কর্মী তাদের কাজ নিয়ে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন (Emotionally Detached) বোধ করেন, যা তাদের সামগ্রিক জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

মনোবিদদের মতে, “মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বস্তুগত জিনিস অর্জন করছে, কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে ব্যর্থ হচ্ছে। যখন জীবনের কোনো বৃহত্তর উদ্দেশ্য বা অর্থ থাকে না, তখন বাহ্যিক সাফল্য সত্ত্বেও ভেতরটা ফাঁকা মনে হয়।”

জীবনে আনন্দ ফিরিয়ে আনার উপায়: The ‘Not Enjoying Life’ Solution

যদি আপনি এই অনুভূতির সাথে নিজেকে মেলাতে পারেন, তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কিছু কার্যকর পদক্ষেপ এবং মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

১. মাইন্ডফুলনেস ও বর্তমানকে গুরুত্ব দেওয়া

মাইন্ডফুলনেস হলো বর্তমান মুহূর্তে কোনো প্রকার বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া মনোযোগ দেওয়ার অভ্যাস। প্রতিদিন অন্তত ১০-১৫ মিনিট মেডিটেশন বা কেবল শান্ত হয়ে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দেওয়া আপনার মস্তিষ্ককে শান্ত করতে পারে। এর মাধ্যমে আপনি অতীতের আফসোস এবং ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমানকে উপভোগ করতে শিখবেন।

২. নতুন কিছু চেষ্টা করা (Breaking the Monotony)

একঘেয়েমি জীবন থেকে আনন্দ কেড়ে নেয়। তাই আপনার রুটিনে নতুন কিছু যোগ করুন। এটি হতে পারে নতুন কোনো ভাষা শেখা, ছবি আঁকা, রান্না করা, বা নতুন কোনো জায়গায় ঘুরতে যাওয়া। নতুন কিছু করার চেষ্টা আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন (Dopamine) নামক হরমোন নিঃসরণ করে, যা আমাদের ভালো লাগার অনুভূতি দেয়।

৩. ডিজিটাল ডিটক্স (Digital Detox)

প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন। এই সময়টা বই পড়া, পরিবারের সাথে কথা বলা বা প্রকৃতির কাছাকাছি কাটান। এটি আপনাকে অন্যদের সাথে নিজের জীবনের তুলনা করার প্রবণতা থেকে মুক্তি দেবে এবং মানসিক শান্তি ফিরিয়ে আনবে।

৪. শরীরচর্চা ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস

শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ব্যায়াম মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন (Endorphin) নিঃসরণ করে, যা প্রাকৃতিক ‘মুড বুস্টার’ হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি, ফল, সবজি এবং পুষ্টিকর খাবার আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা করে।

৫. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ (Practicing Gratitude)

প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তিনটি এমন জিনিসের কথা লিখুন যার জন্য আপনি কৃতজ্ঞ। এটি খুব ছোট কিছু হতে পারে, যেমন – আজকের সুন্দর আবহাওয়া বা বন্ধুর সাথে একটি ভালো কথোপকথন। এই অভ্যাসটি আপনার মনোযোগকে জীবনের ‘নেই’ থেকে ‘আছে’-এর দিকে নিয়ে যাবে এবং সন্তুষ্টি বাড়াবে।

৬. পেশাদার সাহায্য নেওয়া

যদি এই অনুভূতিগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং আপনার দৈনন্দিন জীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে, তবে একজন থেরাপিস্ট বা কাউন্সেলরের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করা শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসার মতোই স্বাভাবিক এবং জরুরি।

সাধারণ জিজ্ঞাস্য (FAQ Section)

১. কেন সবকিছু ঠিক থাকলেও আমার কিছু ভালো লাগে না?

উত্তর: এর পেছনে অ্যানহেডোনিয়া, ল্যাঙ্গুইশিং, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব, বার্নআউট বা অর্থবহ সম্পর্কের অভাবের মতো মনস্তাত্ত্বিক কারণ থাকতে পারে। বাহ্যিক সাফল্যের চেয়ে মানসিক সন্তুষ্টি বেশি জরুরি।

২. অ্যানহেডোনিয়া কি?

উত্তর: অ্যানহেডোনিয়া হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে ব্যক্তি পূর্বে আনন্দদায়ক ছিল এমন কাজ থেকেও আনন্দ পেতে ব্যর্থ হয়। এটি বিষণ্ণতার একটি অন্যতম লক্ষণ।

৩. জীবন উপভোগ করার জন্য কী করতে পারি?

উত্তর: মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন, নতুন শখ তৈরি, ডিজিটাল ডিটক্স, নিয়মিত ব্যায়াম, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং প্রয়োজনে পেশাদার সাহায্য নেওয়ার মাধ্যমে জীবনে আনন্দ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

৪. সোশ্যাল মিডিয়া কীভাবে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে?

উত্তর: সোশ্যাল মিডিয়া অন্যের জীবনের সাথে নিজের জীবনের তুলনা করতে উৎসাহিত করে, সাইবার বুলিং-এর ঝুঁকি বাড়ায় এবং আমাদের মস্তিষ্কের ডোপামিন সিস্টেমকে প্রভাবিত করে আসক্তি তৈরি করতে পারে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

৫. কখন আমার একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া উচিত?

উত্তর: যদি আপনার ভালো না লাগার অনুভূতি দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়, আপনার দৈনন্দিন কাজকর্মে (যেমন: ঘুম, খাওয়া, অফিসের কাজ) ব্যাঘাত ঘটায় এবং নিজের ক্ষতি করার চিন্তা আসে, তাহলে অবিলম্বে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

কোনো বড় সমস্যা ছাড়াই জীবন উপভোগ করতে না পারা বা ‘not enjoying life’ আধুনিক জীবনের একটি জটিল কিন্তু বাস্তব সমস্যা। এটি কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং আমাদের পরিবর্তিত জীবনযাত্রা এবং পারিপার্শ্বিক চাপের একটি সম্মিলিত ফল। সুখ কোনো গন্তব্য নয়, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। নিজের মানসিক অবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া, প্রয়োজনে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই ধূসর অনুভূতি থেকে বেরিয়ে এসে জীবনকে নতুনভাবে উপভোগ করা সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের প্রতি সদয় থাকা এবং মনে রাখা যে, সাহায্য চাওয়া একটি সাহসের কাজ।

About Author
Riddhi Datta

ঋদ্ধি দত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি একজন উদীয়মান বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, যিনি জটিল বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলিকে সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য করে তোলেন। তাঁর লেখায় রসায়ন, পরিবেশ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সমসাময়িক বিষয়গুলি প্রাধান্য পায়। ঋদ্ধি নিয়মিতভাবে এই ওয়েবসাইটে বিজ্ঞান-ভিত্তিক প্রবন্ধ, গবেষণা সারসংক্ষেপ এবং বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন।