numbness and tingling causes: আপনি কি কখনো লক্ষ্য করেছেন যে দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে থাকার পর হাত বা পা অসাড় হয়ে যায়? অথবা রাতে ঘুমানোর সময় হঠাৎ হাত-পা ঝিনঝিন করে উঠে? এই অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই কমবেশি আছে। তবে যদি এই সমস্যাটি নিয়মিত হতে থাকে, তাহলে তা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য একটি সতর্কতার সংকেত হতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকে ‘প্যারেসথেসিয়া’ বা ইংরেজিতে ‘পিনস অ্যান্ড নিডলস’ বলা হয়। সাধারণভাবে এটি একটি সাময়িক সমস্যা হলেও, কিছু ক্ষেত্রে এটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। আসুন জেনে নিই হাত-পা ঝিনঝিন করার পেছনে কী কারণ রয়েছে এবং কখন এটি নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিত।
হাত-পা ঝিনঝিন কী এবং কেন হয়
হাত-পা ঝিনঝিন করা মানে হলো শরীরের কোনো অংশে অসাড়তা, জ্বালাপোড়া বা সূঁচের খোঁচার মতো অনুভূতি হওয়া। এই অনুভূতি এমন যেন অসংখ্য পিঁপড়া হাঁটছে বা কেউ সূঁই দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে। সাধারণত এই সমস্যা হাত বা পায়ে বেশি দেখা যায়, তবে শরীরের যেকোনো অংশেই হতে পারে।
এই সমস্যার মূল কারণ হলো স্নায়ু এবং রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা। আমাদের দেহের সর্বত্র রয়েছে অসংখ্য স্নায়ু, যা মস্তিষ্ক এবং শরীরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করে। যখন কোনো কারণে এই স্নায়ুতে চাপ পড়ে বা রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয়, তখন হাত-পা ঝিনঝিন করার সমস্যা দেখা দেয়।
সাধারণত দীর্ঘক্ষণ এক অবস্থানে বসে বা শুয়ে থাকলে শরীরের কোনো অংশে চাপ পড়ে। এর ফলে সেই অংশের স্নায়ু এবং রক্তনালীতে চাপ পড়ে, যার কারণে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয় এবং ঝিনঝিন অনুভূতি তৈরি হয়।
সাধারণ যে কারণে হাত-পা ঝিনঝিন করে
দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কারণ
দীর্ঘক্ষণ একই অবস্থানে থাকা হাত-পা ঝিনঝিন করার সবচেয়ে সাধারণ কারণ। অফিসে দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করা, টিভি দেখার সময় একই ভঙ্গিতে বসে থাকা, বা ভুল উপায়ে ঘুমানোর কারণে এই সমস্যা হতে পারে।
অনেক সময় খুব নরম বিছানায় ঘুমালে বা ভুল বালিশ ব্যবহার করলেও এই সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত রেখে ঘুমালে হাতে অসাড়তা আসতে পারে।
পুষ্টির অভাবজনিত কারণ
ভিটামিন বি-১২, ভিটামিন বি-৬, ভিটামিন বি-১, এবং ভিটামিন ডি-এর অভাবে হাত-পা ঝিনঝিন করার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ভিটামিন বি-১২ এর অভাব বেশি দেখা যায়, যার কারণে এই সমস্যা হয়।
ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের অভাবেও অনুরূপ সমস্যা হতে পারে। অপুষ্টিতে ভোগা মানুষদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
শারীরিক সমস্যা
মেরুদণ্ডের সমস্যা যেমন সার্ভাইকাল স্পন্ডাইলোসিস বা লাম্বার স্পন্ডাইলোসিসের কারণে স্নায়ুতে চাপ পড়ে এবং হাত-পা ঝিনঝিন করে। কারপাল টানেল সিনড্রোম নামক একটি রোগের কারণে বিশেষ করে হাতের কবজিতে এই সমস্যা হয়।
রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা, যেমন পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজের কারণেও এই উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
গুরুতর রোগের লক্ষণ হিসেবে হাত-পা ঝিনঝিন
ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি
হাত-পা ঝিনঝিন করার পেছনে সবচেয়ে গুরুতর কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হলো ডায়াবেটিস। গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় ৩০% ক্ষেত্রে এই সমস্যার কারণ হলো ডায়াবেটিস। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৬০-৭০% রোগীর মধ্যে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি দেখা দেয়।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথিতে প্রথমে পায়ের পাতায় ঝিনঝিন করা শুরু হয়, পরে তা উপরের দিকে ছড়িয়ে যায়। অনেক সময় রোগী বুঝতেই পারেন না যে পা থেকে চপ্পল খুলে গেছে বা পায়ে আঘাত লেগেছে।
থাইরয়েড এবং হরমোনের সমস্যা
থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা, বিশেষ করে হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণে হাত-পা ঝিনঝিন করতে পারে। নারীদের মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাবেও এই সমস্যা দেখা দেয়।
কিডনি এবং লিভারের রোগ
কিডনি অকার্যকর হয়ে গেলে বা লিভারের সমস্যা থাকলে রক্তে বিষাক্ত পদার্থ জমে যায়, যার কারণে স্নায়ুর ক্ষতি হয় এবং ঝিনঝিন অনুভূতি হয়।
হৃদরোগ এবং স্ট্রোক
বিশেষ করে বাম হাতে ঝিনঝিন অনুভূতি হার্ট অ্যাটাকের একটি সতর্কতামূলক লক্ষণ হতে পারে। যদি বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বা মাথা ঘোরার সাথে বাম হাতে অসাড়তা থাকে, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
স্ট্রোকের ক্ষেত্রেও হঠাৎ করে শরীরের এক পাশে অসাড়তা দেখা দিতে পারে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন
যদি হাত-পা ঝিনঝিন করার সমস্যা নিম্নলিখিত অবস্থায় থাকে, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
-
সমস্যাটি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে
-
রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে
-
হাত বা পায়ের শক্তি কমে গেলে
-
হাঁটাচলায় সমস্যা হলে
-
বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্টের সাথে থাকলে
-
জ্বর, বমি বা অন্যান্য উপসর্গের সাথে থাকলে
-
কোনো জিনিস ধরতে বা মুষ্টিবদ্ধ করতে অসুবিধা হলে
এছাড়া যদি আপনার ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, বা অন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদী রোগ থাকে এবং নতুন করে হাত-পা ঝিনঝিন করার সমস্যা শুরু হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
রোগ নির্ণয় এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা
চিকিৎসক প্রথমে রোগীর বিস্তারিত ইতিহাস জানতে চাইবেন এবং শারীরিক পরীক্ষা করবেন। এরপর প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলো করতে বলতে পারেন:
-
রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা
-
ভিটামিন বি-১২ এর মাত্রা পরীক্ষা
-
থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট
-
কিডনি ফাংশন টেস্ট
-
নার্ভ কন্ডাকশন টেস্ট
-
ইএমজি (ইলেক্ট্রোমাইওগ্রাফি)
এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে হাত-পা ঝিনঝিন করার সঠিক কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়।
চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনা
কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা
হাত-পা ঝিনঝিন করার চিকিৎসা নির্ভর করে এর কারণের উপর। ডায়াবেটিস থাকলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে সেটির চিকিৎসা করতে হবে।
ভিটামিনের অভাব থাকলে পুষ্টিকর খাবার এবং প্রয়োজনে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে প্রিগাবালিন বা এমিট্রিপটাইলিন জাতীয় ওষুধ দীর্ঘমেয়াদে সেবন করতে হতে পারে।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন
-
দীর্ঘক্ষণ একই অবস্থানে না থেকে নিয়মিত বিরতি নিন
-
কম্পিউটার কাজের সময় প্রতি ৩০ মিনিটে একবার বিরতি নিন
-
সঠিক ভঙ্গিতে বসুন এবং শুয়ে থাকুন
-
নিয়মিত ব্যায়াম করুন, বিশেষ করে হাত-পায়ের ব্যায়াম
-
ধূমপান এবং অতিরিক্ত মদ্যপান ত্যাগ করুন
ঘরোয়া প্রতিকার
-
আক্রান্ত স্থানে হালকা ম্যাসাজ করুন
-
গরম পানির সেঁক নিন (খুব গরম নয়)
-
সঠিক মাপের এবং আরামদায়ক জুতা পরুন
-
রাতে ঘুমানোর সময় রিস্ট স্প্লিন্ট ব্যবহার করুন (যদি কারপাল টানেল সিনড্রোম থাকে)
প্রতিরোধের উপায়
হাত-পা ঝিনঝিন করার সমস্যা প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মেনে চলুন:
-
সুষম খাবার খান এবং পর্যাপ্ত ভিটামিন গ্রহণ করুন
-
নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং সুস্থ ওজন বজায় রাখুন
-
ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন
-
কর্মক্ষেত্রে সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখুন
-
দীর্ঘক্ষণ একই কাজ করার সময় বিরতি নিন
-
পর্যাপ্ত পানি পান করুন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা মেনে চলুন
হাত-পা ঝিনঝিন করার সমস্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ এবং সাময়িক হলেও, এটি কখনো কখনো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। তাই এই সমস্যাকে অবহেলা না করে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক কারণ নির্ণয় এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। একই সাথে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং নিয়মিত চেকআপের মাধ্যমে এই সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়।