শীতে ত্বকের সমস্যা: আগে কারণটা বুঝুন
শীতকালে আর্দ্রতা কমে যাওয়া, ঠান্ডা বাতাস আর ঘরের হিটার/রুম হিটার ত্বকের উপরিভাগ থেকে পানি টেনে নিয়ে শুষ্কতা বাড়িয়ে দেয়, যাকে ডার্মাটোলজি ভাষায় xerosis বলা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, আর্দ্রতা ১০%–এর নিচে নেমে গেলে শুষ্কতা ও চুলকানি অনেক বেশি বেড়ে যায়, যা শীতের শেষ দিকে খুব সাধারণ একটি সমস্যা হিসেবে ধরা পড়ে।
একটি মার্কিন সার্ভেতে দেখা গেছে, শীতে মানুষের সবচেয়ে বিরক্তিকর স্কিন সমস্যার মধ্যে ৬৯% মানুষ ড্রাইনেস, ৫১% চুলকানি আর ২৪% রেডনেসকে দোষী করেছে, যা প্রমাণ করে এই মৌসুমে স্কিন-বারিয়ার কতটা ভঙ্গুর হয়ে যায়। কোরিয়ায় করা এক ইনডোর-উইন্টার স্টাডিতে দেখা যায়, মাত্র কয়েক ঘণ্টা শুষ্ক, গরম ঘরে থাকলেই ত্বকের হাইড্রেশন কমে ও ট্রান্সএপিডার্মাল ওয়াটার লস (TEWL) প্রায় ২০–২৫% পর্যন্ত বাড়তে পারে, যদি সঠিক ময়েশচারাইজার না ব্যবহার করা হয়।
শীতের সাধারণ ত্বক–সমস্যা ও দ্রুত সমাধান
| সমস্যা (শীতে) | মূল কারণ | ডার্মাটোলজিস্ট–ইনস্পায়ার্ড সমাধান |
|---|---|---|
| অতিরিক্ত শুষ্কতা ও টান টান ভাব | কম আর্দ্রতা, হিটার/গিজার, গরম পানি | ঘন ক্রিম/অয়েন্টমেন্ট টাইপ ময়েশচারাইজার, ceramide ও lipids–সমৃদ্ধ ফর্মুলা, স্নানের সাথে সাথে লাগানো |
| চুলকানি ও লালচে প্যাচ | স্কিন–বারিয়ার দুর্বল হওয়া, খসখসে ত্বক ঘর্ষণ | ফ্র্যাগ্র্যান্স–ফ্রি জেন্টল ক্লিনজার, অ্যালকোহল–ফ্রি টোনার, বারিয়ার–রিপেয়ার ক্রিম, অতিরিক্ত স্ক্রাব বন্ধ |
| ফাউন্ডেশন বসছে না, প্যাচি দেখাচ্ছে | স্কিন ডিহাইড্রেটেড, ফ্লেকসের উপর ম্যাট প্রোডাক্ট | আগে এক্সফোলিয়েশন (মৃদু), তারপর হাইড্রেটিং প্রাইমার ও ডিউই/সাটিন ফাউন্ডেশন; কম পাউডার |
| ঠোঁট ফেটে যাওয়া ও লিপস্টিক ক্র্যাক হওয়া | ঠান্ডা বাতাস + ডিহাইড্রেশন | রাতে ঘন লিপ বাম, দিনে SPF লিপ বাম ও ক্রিমি লিপস্টিক/টিন্ট |
এই বৈজ্ঞানিক ব্যাকড্রপ জানলে বোঝা যায়, শীতের মেকআপের ৭০–৮০% সাকসেস আসলে স্কিনকেয়ারের উপর নির্ভর করে, কালার কসমেটিকের উপর না। তাই শীতের মেকআপ গাইড শুরুই হবে স্কিন–প্রেপ দিয়ে।
শীতে মেকআপের বেস: স্কিনকেয়ারই আসল
বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতকালে ফেস–ওয়াশ থেকে শুরু করে ময়েশচারাইজার পর্যন্ত সবকিছু একটু “জেন্টল ও রিচ” রাখতে হয়, যাতে স্কিন–বারিয়ার ভাঙা না পড়ে। অনেক ডার্মাটোলজিস্ট শীতে লোশন বাদ দিয়ে ক্রিম বা অয়েন্টমেন্ট টাইপ ময়েশচারাইজার ব্যবহারের পরামর্শ দেন, যেগুলোতে ceramide, lipids ও hyaluronic acid থাকে – এগুলো স্কিনে পানির পরত ধরে রাখে।
কোরিয়ার একটি স্টাডিতে দেখা গেছে, ৫% ceramide–যুক্ত ক্রিম ব্যবহারে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাইড্রেশন বেড়েছে এবং TEWL কমেছে, এমনকি নরমাল স্কিনেও বেসিক ইনডোর–উইন্টার ড্যামেজ অনেকটা ঠেকানো গেছে। আমেরিকান একাডেমি অব ডার্মাটোলজি (AAD)–এর গাইডলাইনেও বলা আছে, মুখ ধোয়ার পর ভেজা স্কিনেই সাথে সাথে ময়েশচারাইজার লাগালে আর্দ্রতা অনেক বেশি সময় ধরে রাখা যায়।
শীতে মেকআপের আগে আদর্শ স্কিন–প্রেপ (Day time) হতে পারে:
-
নরমাল/ড্রাই স্কিনের জন্য সালফেট–ফ্রি, জেন্টল ক্লিনজার ব্যবহার করুন; ফোমিং, অ্যালকোহলিক ক্লিনজার এড়িয়ে চলুন।
-
ক্লিনজিংয়ের সাথে সাথে হালকা হাইড্রেটিং টোনার বা এসেন্স লাগাতে পারেন (গ্লিসারিন/হায়ালুরোনিক এসিড–সমৃদ্ধ হলে ভালো)।
-
এরপর ceramide, lipids, niacinamide বা hyaluronic acid–সমৃদ্ধ একটি ঘন ক্রিম ময়েশচারাইজার ব্যবহার করুন।
-
ডে–টাইমে কমপক্ষে SPF 30–যুক্ত ব্রড–স্পেকট্রাম সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন, কারণ UV index ৩ বা তার বেশি হলেই স্কিন ড্যামেজ হতে পারে – এটা গরম/শীত কোনটাই দেখে না।
-
ঠোঁটে থিক লেয়ার লিপ বাম লাগিয়ে ২–৩ মিনিট অপেক্ষা করুন, তারপর মেকআপ শুরু করুন।
এভাবে স্কিন ভালোভাবে প্রেপ করলে পরের ধাপের ফাউন্ডেশন, কনসিলার, ব্লাশ সবকিছু অনেক বেশি ন্যাচারাল ও লং–লাস্টিং দেখায়।
শীতকালে রক্তচাপ বাড়ে না কমে? যা বলছে সাম্প্রতিক গবেষণা – সতর্ক না হলে বিপদ!
ধাপে ধাপে শীতের মেকআপ লুক
শীতে মেকআপের মূল টার্গেট হওয়া উচিত – “হাইড্রেটেড কিন্তু টেকসই বেস” আর “সফট, ব্লেন্ডেড কালার”, যাতে স্কিন ফ্লেকি বা কেকি না লাগে। হালকা লেয়ারিং, ক্রিম–বেসড প্রোডাক্ট আর কম পাউডার ব্যবহার করলেই অনেক বেশি ফ্রেশ ও স্কিন–লাইক ফিনিশ পাওয়া যায়।
শীতকালের জন্য একটি ব্যবহার–উপযোগী স্টেপ–বাই–স্টেপ রুটিন:
-
হাইড্রেটিং প্রাইমার: নরমাল থেকে ড্রাই স্কিন হলে হাইড্রেটিং/গ্লোয়ি প্রাইমার নিন; অয়েলি স্কিন হলে T–zone–এ লাইট ম্যাটিফাইং, আর বাকিটায় হাইড্রেটিং প্রাইমার ব্যবহার করুন।
-
ফাউন্ডেশন বা BB/CC ক্রিম: খুব ফুল–কভারেজ ম্যাট ফাউন্ডেশন শীতে সহজে ক্র্যাক করে, তাই মিডিয়াম কভারেজ, ডিউই/সাটিন ফিনিশ ফাউন্ডেশন বা BB/CC ক্রিম বেছে নিন; চাইলে বিউটি স্পঞ্জ দিয়ে ভেজা–ভেজাভাবে ব্লেন্ড করুন যেন স্কিনের ন্যাচারাল টেক্সচার দেখা যায়।
-
কনসিলার: শুধু চোখের নিচে ও স্পটের উপর অল্প কনসিলার দিন, বেশি প্রোডাক্ট জমলে ফাইন লাইনগুলো বেশি দেখা যায় – শুষ্ক স্কিনে এটা বিশেষভাবে সমস্যা করে।
-
ক্রিম ব্লাশ ও কনটুর: শীতে পাউডার ব্লাশ খুব দ্রুত প্যাচি হতে পারে, তাই ক্রিম বা লিকুইড ব্লাশ গাল ও নাকের পাশে হালকা ট্যাপ করে লাগান; চাইলে খুব সফট ক্রিম কনটুর দিয়ে ফেস শেপ ডিফাইন করতে পারেন।
-
ক্রিম/পেন্সিল হাইলাইটার: পাউডার হাইলাইটার শুষ্ক স্কিনের টেক্সচার বেশি হাইলাইট করে, তাই ক্রিম বা স্টিক হাইলাইটার চীকবোন, নাকের ব্রিজ, কিউপিড’স বো–তে হালকা লাগালে হেলদি, ভেতর থেকে আসা গ্লো দেখায়।
-
চোখের মেকআপ: শীতে পাউডারি আইশ্যাডো যদি খুব ম্যাট হয়, তবে ঢিলা স্কিন বা ড্রাই লিডে কেকি লাগতে পারে; তাই ক্রিম–টু–পাউডার বা সাটিন ফিনিশ শেড ব্যবহার করুন, আই–প্রাইমার ব্যবহার করলে ক্রিজিং কমে।
-
আইলাইনার ও মাসকারা: ওয়াটারপ্রুফ মাসকারা ঠান্ডা ও পানির (কুয়াশা/চোখে পানি) কারণে স্মাজিং কমায়; আইলাইনার পেন্সিল বা জেল বেছে নিন যেন দ্রুত শুকিয়ে যায়।
-
ভ্রু (Eyebrows): শীতে ব্রাউ জেল খুব ড্রাই লাগলে হালকা ওয়াক্স/টিন্টযুক্ত প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে পারেন, যা ভ্রুকে জায়গায় রাখবে কিন্তু শক্ত প্লাস্টিকের মত লাগবে না।
-
লিপ মেকআপ: আগে ঠোঁট হালকা স্ক্রাব (সপ্তাহে ২ বার), তারপর লিপ বাম; তার উপর ক্রিমি লিপস্টিক বা পিগমেন্টেড লিপ বাম দিন – ম্যাট চাইলে শেষে খুব হালকা টিস্যু দিয়ে ব্লট করুন, কিন্তু লিপসকে সম্পূর্ণ শুষ্ক করে ফেলবেন না।
-
সেটিং পাউডার ও স্প্রে: পুরো মুখে মোটা পাউডার না দিয়ে শুধু T–zone (নাক, কপাল, চিবুক)–এ হালকা ডাস্ট করুন; শেষে হাইড্রেটিং সেটিং স্প্রে দিলে পাউডার ও ক্রিমের লেয়ার একসাথে গলে ন্যাচারাল ফিনিশ দেয়।
এই সব স্টেপ সঠিকভাবে করলে শীতে ৮–১০ ঘন্টা পর্যন্ত ফ্রেশ, ফ্লেক–ফ্রি লুক ধরে রাখা তুলনামূলক সহজ হয়, বিশেষ করে যদি স্কিন–প্রেপ ঠিকমতো করা থাকে।
আগুনে পোড়া রোগীদের স্কিন প্রতিস্থাপন: জীবন বাঁচানোর আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি
বিভিন্ন ত্বকের ধরন ও শীতের মেকআপ টিউনিং
শীতকালে অয়েলি, ড্রাই, সেনসিটিভ, মেচিউর – প্রত্যেক স্কিনটাই একটু আলাদা কেয়ার চায়, তাই সবার জন্য একই মেকআপ রুটিন কাজ নাও করতে পারে। অনেক ডার্মাটোলজিস্ট শীতে শক্তিশালী একটিভ (যেমন রেটিনল, AHA/BHA)–এর ব্যবহার কমাতে বলেন, কারণ এগুলো ড্রাইনেস ও সেনসিটিভিটি বাড়িয়ে মেকআপ সিটিংকেও প্রভাবিত করতে পারে।
-
ড্রাই/ডিহাইড্রেটেড স্কিন: ঘন ক্রিম ময়েশচারাইজার, ফেস–অয়েল বা ওয়াটার–ইন–অয়েল ফাউন্ডেশন বেছে নিন; পাউডার যত কম, তত ভালো। রাতে বারিয়ার রিপেয়ার ক্রিম ব্যবহার করলে ফ্লেকিং কমে, ফলে পরদিন মেকআপ অনেক স্মুথ হয়।
-
অয়েলি/কম্বিনেশন স্কিন: T–zone–এ লাইট জেল ময়েশচারাইজার, অন্য জায়গায় ক্রিম–বেসড প্রোডাক্ট ব্যবহার করুন; খুব হার্ড ম্যাট ফাউন্ডেশন না নিয়ে লং–ওয়্যার সাটিন ফিনিশ বেছে নিন, আর অয়েল–কন্ট্রোল পাউডার শুধু যেসব জায়গা দ্রুত তৈলাক্ত হয় সেখানে লাগান।
-
সেনসিটিভ বা রোসেশিয়া–প্রোন স্কিন: ফ্র্যাগ্র্যান্স–ফ্রি, অ্যালকোহল–ফ্রি, হাইপোঅ্যালার্জেনিক প্রডাক্ট বেছে নিন; রেডনেস ঢাকতে সবুজ আন্ডারটোন–যুক্ত কালার কারেক্টর অল্প ব্যবহার করতে পারেন, তবে রাবিং এড়িয়ে ট্যাপ–ট্যাপ করে ব্লেন্ড করুন।
-
মেচিউর স্কিন: শীতে ফাইন লাইন বেশি স্পষ্ট হয়, তাই খুব ভারী পাউডার ও ফুল–কভারেজ ম্যাট ফাউন্ডেশন এড়িয়ে চলাই ভালো; হালকা, হাইড্রেটিং ফর্মুলা, ক্রিম ব্লাশ ও কনটুর মেচিউর স্কিনে বেশি ইয়ুথফুল লুক দেয়।
UV রশ্মির কথাও এখানে জরুরি: গবেষণায় দেখা গেছে, পাহাড়ি এলাকায় প্রতি ১০০০ মিটার উচ্চতায় UV তীব্রতা প্রায় ১০–১৫% পর্যন্ত বাড়ে এবং তুষার প্রায় ৮০% UV রে রিফ্লেক্ট করতে পারে, ফলে স্কি/ট্রেকিং–এ শীতেও সানবার্নের ঝুঁকি অনেক বেশি থেকে যায়। বিশ্বব্যাপী গৃহীত UV index–স্কেলে ৩ বা তার বেশি হলেই সান–প্রোটেকশন নেওয়া উচিত বলে বিভিন্ন ক্যান্সার ও স্বাস্থ্য সংস্থা পরামর্শ দেয়, যা সারা বছর প্রযোজ্য।
দৈনন্দিন রুটিন, লং–টার্ম কেয়ার ও SEO ডাটা
শীতকালে প্রতিদিন মেকআপ করুন বা না–ই করুন, একটা বেসিক রুটিন – জেন্টল ক্লিনজার, ঘন ময়েশচারাইজার, SPF, রাতে বারিয়ার–রিপেয়ার – মেনে চললে স্কিন–বারিয়ার স্ট্রং থাকে এবং মেকআপ বসাও সহজ হয়। ডার্মাটোলজি প্রতিষ্ঠানের গাইডলাইনগুলোতে শীতে গরম পানিতে বেশি সময় স্নান না করা, স্নানের পর ভেজা ত্বকে সঙ্গে সঙ্গে ক্রিম লাগানো, আর ঘরে হিউমিডিফায়ার/বালতি–পানি ব্যবহার করে আর্দ্রতা কিছুটা বাড়িয়ে রাখার কথা বলা হয়।
নিয়মিত সঠিক কেয়ার নিলে ড্রাইনেস, চুলকানি, রেডনেস কমে যায়, ফলে মেকআপ কেবল “ঢেকে রাখা”র কাজ না করে বরং গ্লো বাড়ানোর কাজ করে। সঙ্গে কিছু ডেইলি–ডু’স & ডোন’টস মেনে চলা ভালো:
-
প্রতিদিন রাতে মেকআপ সম্পূর্ণ তুলে ক্লিনজ–ময়েশচারাইজ–লিপ কেয়ার করুন; ক্লিনজার যেন স্কিনকে “কড়া টান” না দেয়।
-
সপ্তাহে ১–২ দিন জেন্টল কেমিক্যাল বা এনজাইম–এক্সফোলিয়েশন করে ফ্লেকস তুলুন; হার্ড স্ক্রাব এড়িয়ে চলুন।
-
লং–ওয়্যার লিকুইড লিপস্টিক পরার আগে সবসময় লিপ বাম বেস রাখুন; খুব বেশি লেয়ার করলে ঠোঁট ফাটার ঝুঁকি বাড়ে।
-
ঘন ঘন গরম হিটার/ব্লোয়ার ফেসের দিকে লাগাবেন না; প্রয়োজনে রুম হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন, যা অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিক শীতের ড্রাইনেস কমাতে সাজেস্ট করে।
-
বিশেষ কোনো স্কিন কন্ডিশন (একজিমা, সোরিয়াসিস, রোসেশিয়া) থাকলে নিজের ডার্মাটোলজিস্টের সাজেশন অনুযায়ী কসমেটিক বেছে নিন – কোন প্রডাক্ট “নিরাপদ” তা ডাক্তারই ভালো বলতে পারবেন।











