এক রাতের মধ্যেই যেন বদলে গেল সবকিছু। ভারতের প্রায় ৫৯ কোটি অনলাইন গেমারের 1 কাছে ২২শে আগস্ট, ২০২৫ তারিখের সকালটা ছিল এক বিরাট ধাক্কার মতো। যাঁরা প্রতিদিন Dream11-এ দল সাজাতেন, MPL-এ ছোট ছোট গেমে অংশ নিতেন বা WinZO-তে বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মাততেন, তাঁরা দেখলেন তাঁদের প্রিয় অ্যাপগুলি আর আগের মতো কাজ করছে না। ক্যাশ কনটেস্টের জায়গা ফাঁকা, টাকা জমা দেওয়ার অপশন উধাও। এক কথায়, যে রিয়েল-মানি গেমিং শিল্প এতদিন ধরে ভারতে দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করছিল, তা যেন এক মুহূর্তেই থমকে গেছে। এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ হলো ভারত সরকারের পাশ করা এক নতুন আইন—’The Promotion and Regulation of Online Gaming Bill, 2025′ । এই বিলটি অনলাইন গেমিং জগতের নিয়মনীতিকে আমূল বদলে দিয়েছে। ব্যবহারকারীদের মনে এখন হাজারো প্রশ্ন: ঠিক কী ঘটেছে? কেন এই নিষেধাজ্ঞা?
WinZO, Dream11, MPL: এখন কাজ করছে না এমন অনলাইন মানি গেমিং প্ল্যাটফর্মের সম্পূর্ণ তালিকা কোনটি? আর সবচেয়ে বড় চিন্তা, অ্যাপের ওয়ালেটে থাকা টাকার কী হবে? এই প্রতিবেদনে আমরা এই নতুন আইনের প্রতিটি দিক গভীরভাবে বিশ্লেষণ করব, বন্ধ হয়ে যাওয়া প্ল্যাটফর্মগুলির সম্পূর্ণ তালিকা দেব এবং ভারতীয় গেমিং শিল্পের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আলোকপাত করব।
নতুন আইন আসলে কী? কেন এই কড়া পদক্ষেপ নিল সরকার?
এই ব্যাপক পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে ‘The Promotion and Regulation of Online Gaming Bill, 2025’ নামের একটি আইন, যা ভারতীয় সংসদ ২০২৫ সালের ২১শে আগস্ট পাশ করেছে । এই আইনটি কেবল কিছু নিয়মকানুন বদলায়নি, বরং অনলাইন গেমিং শিল্পের একটি বড় অংশকে সরাসরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সরকারের এই পদক্ষেপের পিছনে রয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সুরক্ষাগত কিছু গভীর উদ্বেগ।
‘অনলাইন মানি গেম’-এর সংজ্ঞা: আইনের চোখে কোনটি বৈধ আর কোনটি অবৈধ?
নতুন আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘অনলাইন মানি গেম’-এর সংজ্ঞা নির্ধারণ। আইন অনুযায়ী, যেকোনো অনলাইন গেম, যেখানে ব্যবহারকারী টাকা জমা দিয়ে বা কোনো প্রবেশমূল্য দিয়ে অংশ নেয় এবং তার বিনিময়ে টাকা বা অন্য কোনো আর্থিক পুরস্কার জেতার আশা রাখে, তাকেই ‘অনলাইন মানি গেম’ হিসেবে গণ্য করা হবে ।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই আইন ‘গেম অফ স্কিল’ (দক্ষতার খেলা) এবং ‘গেম অফ চান্স’ (ভাগ্যের খেলা)-এর মধ্যে কোনো পার্থক্য করেনি । এর অর্থ, এতদিন ধরে ফ্যান্টাসি স্পোর্টস (যেমন Dream11) বা রামি (Rummy) যেগুলিকে দক্ষতার খেলা হিসেবে আইনি সুরক্ষা দেওয়া হতো, সেগুলিও এখন এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় চলে এসেছে। আইনের চোখে, টাকা জড়িত থাকলেই তা নিষিদ্ধ, তা সে দক্ষতার খেলা হোক বা ভাগ্যের। তবে, ই-স্পোর্টস এবং সোশ্যাল গেমিং, যেখানে কোনো আর্থিক লেনদেন বা পুরস্কারের আশা থাকে না, সেগুলিকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে এবং সরকার সেগুলিকে উৎসাহিত করার কথা বলেছে ।
নিষেধাজ্ঞা শুধু গেমিং-এ নয়: বিজ্ঞাপন এবং আর্থিক লেনদেনেও তালা
সরকার এই নিষেধাজ্ঞাকে কার্যকর করতে একটি ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যা এই শিল্পের টিকে থাকাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।
- পরিষেবা প্রদান নিষিদ্ধ: কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা ভারতে অনলাইন মানি গেমিং পরিষেবা প্রদান করতে পারবে না ।
- বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ: এই ধরনের প্ল্যাটফর্মের যেকোনো ধরনের বিজ্ঞাপন—টিভি, ডিজিটাল মিডিয়া বা অন্য কোনো মাধ্যমে—সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।
- আর্থিক লেনদেন বন্ধ: সমস্ত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং পেমেন্ট গেটওয়েকে এই ধরনের গেমিং প্ল্যাটফর্মের জন্য যেকোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন প্রক্রিয়া করতে বারণ করা হয়েছে 9। এই পদক্ষেপটি কার্যত এই প্ল্যাটফর্মগুলির আয়ের উৎসকে পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে।
আইন ভাঙলে কী শাস্তি? কড়া জরিমানা ও জেলের বিধান
এই আইনকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকার আইন অমান্যকারীদের জন্য অত্যন্ত কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে।
- প্ল্যাটফর্ম অপারেটরদের জন্য: যারা অনলাইন মানি গেমিং পরিষেবা চালাবেন, তাদের জন্য তিন বছর পর্যন্ত জেল এবং ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে । বারবার একই অপরাধ করলে শাস্তি বেড়ে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা দ্বিগুণ হতে পারে ।
- বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য: যারা এই ধরনের গেমের বিজ্ঞাপন দেবেন, তাদের জন্য দুই বছর পর্যন্ত জেল এবং ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে । এর মধ্যে সেলিব্রিটি এবং ইনফ্লুয়েন্সাররাও অন্তর্ভুক্ত, যাঁরা এই প্ল্যাটফর্মগুলিকে প্রচার করেন ।
- আর্থিক সংস্থাগুলির জন্য: যে সমস্ত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে লেনদেনে সাহায্য করবে, তাদের জন্যও অপারেটরদের মতোই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ।
সরকারের যুক্তি: কেন এই ‘গণস্বার্থ’-এর সিদ্ধান্ত?
সরকারের পক্ষ থেকে এই কঠোর পদক্ষেপের পিছনে একাধিক সামাজিক কারণ তুলে ধরা হয়েছে। তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের মতে, অনলাইন মানি গেমিং সমাজে “মাদকের চেয়েও বড় সমস্যা” হয়ে দাঁড়িয়েছে । সরকারের প্রধান যুক্তিগুলি হলো:
- গেমিং আসক্তি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) গেমিং আসক্তিকে একটি মানসিক ব্যাধি বা ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে । সরকারের মতে, এই ধরনের গেমগুলি, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে, মারাত্মক আসক্তি তৈরি করছে।
- আর্থিক ক্ষতি ও আত্মহত্যা: বহু মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবকরা, এই গেমগুলিতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। আর্থিক ক্ষতির কারণে আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটেছে, যা সরকারকে এই বিষয়ে কড়া হতে বাধ্য করেছে ।
- আর্থিক জালিয়াতি ও অর্থ পাচার: এই প্ল্যাটফর্মগুলিকে প্রায়শই আর্থিক জালিয়াতি, অর্থ পাচার (মানি লন্ডারিং) এবং এমনকি সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে ।
- জাতীয় নিরাপত্তা: এই অ্যাপগুলির মাধ্যমে দেশের বাইরে টাকা পাচার এবং অন্যান্য বেআইনি কার্যকলাপ জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে বলে সরকার মনে করে ।
পূর্ববর্তী নিয়ন্ত্রক কাঠামো, যা ২০২৩ সালে চালু হয়েছিল এবং স্ব-নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির মাধ্যমে শিল্পকে পরিচালনা করার চেষ্টা করেছিল, তা বাতিল করে সরকার একটি সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার পথে হেঁটেছে 19। এটি একটি সাধারণ নীতি পরিবর্তন নয়, বরং একটি মৌলিক আদর্শগত পরিবর্তন। সরকার স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, এই শিল্পের থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ জিএসটি রাজস্বের ক্ষতি স্বীকার করেও তারা বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর ।
কোন কোন গেমিং প্ল্যাটফর্ম এখন আর কাজ করছে না?
নতুন আইন কার্যকর হওয়ার সাথে সাথেই ভারতের প্রায় সমস্ত বড় রিয়েল-মানি গেমিং প্ল্যাটফর্ম তাদের পরিষেবা বন্ধ বা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। ব্যবহারকারীদের সুবিধার জন্য, নিচে WinZO, Dream11, MPL: এখন কাজ করছে না এমন অনলাইন মানি গেমিং প্ল্যাটফর্মের সম্পূর্ণ তালিকা দেওয়া হলো।
বন্ধ হওয়া প্ল্যাটফর্মের সম্পূর্ণ তালিকা
- Dream11: ভারতের বৃহত্তম ফ্যান্টাসি স্পোর্টস প্ল্যাটফর্মটি তাদের সমস্ত “Pay to Play” বা টাকা দিয়ে খেলার প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন এটি একটি ফ্রি-টু-প্লে প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে ।
- MPL (Mobile Premier League): এই জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মটি টাকা জমা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে এবং সমস্ত রিয়েল-মানি গেম স্থগিত করেছে ।
- WinZO: এই প্ল্যাটফর্মটিও আইন মেনে তাদের সমস্ত রিয়েল-মানি গেম তুলে নিয়েছে ।
- Zupee: লুডো এবং অন্যান্য ক্যাজুয়াল গেমের জন্য পরিচিত Zupee তাদের পেইড গেমগুলি বন্ধ করে দিয়েছে। তবে, তাদের জনপ্রিয় গেম যেমন Ludo Supreme, Snakes & Ladders ইত্যাদি বিনামূল্যে খেলার জন্য উপলব্ধ রয়েছে ।
- PokerBaazi: ভারতের অন্যতম প্রধান পোকার প্ল্যাটফর্ম PokerBaazi তাদের সমস্ত রিয়েল-মানি অপারেশন স্থগিত করেছে ।
- RummyCulture (Gameskraft): এই রামি প্ল্যাটফর্মটি তাদের “Add Cash” এবং গেমপ্লের ফিচারগুলি বন্ধ করে দিয়েছে ।
- My11Circle (Games24x7): Dream11-এর অন্যতম প্রধান প্রতিযোগী My11Circle টাকা জড়িত সমস্ত পরিষেবা স্থগিত করেছে ।
- Probo: ওপিনিয়ন ট্রেডিং-এর এই প্ল্যাটফর্মটি ভারতে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে ।
- A23 Rummy & A23 Poker (Head Digital Works): এই সংস্থাও তাদের সমস্ত অনলাইন মানি গেম বন্ধ করে দিয়েছে ।
আপনার অ্যাকাউন্টের টাকার কী হবে? সংস্থাগুলির বার্তা
এই আকস্মিক পরিবর্তনে ব্যবহারকারীদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ তাদের অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা নিয়ে। তবে, প্রায় সমস্ত বড় প্ল্যাটফর্মই ব্যবহারকারীদের আশ্বস্ত করেছে। তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্টে থাকা সমস্ত টাকা “সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ” এবং টাকা তোলার (withdrawal) সুবিধা আগের মতোই চালু থাকবে । সংস্থাগুলি ব্যবহারকারীদের এই পরিবর্তনকালীন সময়ে ধৈর্য ধরতে এবং যেকোনো প্রয়োজনে তাদের কাস্টমার সাপোর্টের সাথে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেছে।
অর্থনীতির উপর বিরাট আঘাত: চাকরি, বিনিয়োগ এবং রাজস্বের ভবিষ্যৎ কী?
এই নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র গেমিং অ্যাপ বা ব্যবহারকারীদের উপরই প্রভাব ফেলেনি, বরং ভারতীয় অর্থনীতির একটি ক্রমবর্ধমান ক্ষেত্রের উপর একটি বিশাল আঘাত হেনেছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব চাকরি, বিনিয়োগ এবং এমনকি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটের উপরও পড়তে চলেছে।
সংখ্যায় সংকট: কত বড় এই গেমিং শিল্প?
নিষেধাজ্ঞার আগে ভারতীয় অনলাইন গেমিং শিল্প এক বিরাট আকার ধারণ করেছিল। এর масштаব বুঝতে কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক:
- মূল্যায়ন: এই শিল্পের মোট মূল্যায়ন ছিল প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা বা ২৫ বিলিয়ন ডলার ।
- রাজস্ব: সংস্থাগুলি বছরে ৩১,০০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করত ।
- ব্যবহারকারী: ভারতে অনলাইন গেমারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৯১ মিলিয়ন , যা বিশ্বের মোট গেমারের ২০%।
- রিয়েল-মানি গেমিং-এর আধিপত্য: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই শিল্পের মোট রাজস্বের প্রায় ৮৫.৭% আসত রিয়েল-মানি গেমিং (RMG) থেকে 2। অর্থাৎ, যে অংশটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেটিই ছিল এই শিল্পের মূল চালিকাশক্তি।
লক্ষ লক্ষ চাকরি এবং কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে
এই বিশাল শিল্পের উপর নিষেধাজ্ঞার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে চাকরি এবং বিনিয়োগের উপর। শিল্প সংস্থাগুলির মতে, এই বিলের কারণে:
- চাকরি সংকট: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২ লক্ষেরও বেশি চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়েছে । এর মধ্যে গেম ডেভেলপার, গ্রাফিক ডিজাইনার, মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ এবং আরও অনেকে রয়েছেন।
- সংস্থা বন্ধের আশঙ্কা: প্রায় ৪০০-র বেশি গেমিং স্টার্টআপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ।
- বিনিয়োগে খরা: এই শিল্পে প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকা বা ৩ বিলিয়ন ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (FDI) এসেছিল । এই আকস্মিক নিষেধাজ্ঞার ফলে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
শুধু গেমিং নয়, ক্রিকেট থেকে বিজ্ঞাপন—সর্বত্র প্রভাব
এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব শুধুমাত্র প্রযুক্তি জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এর ঢেউ আছড়ে পড়েছে ভারতের ক্রীড়া এবং বিজ্ঞাপন জগতেও। ফ্যান্টাসি স্পোর্টস সংস্থাগুলি ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনদাতা। তারা বছরে প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকারও বেশি বিজ্ঞাপন দিত, যার সিংহভাগই যেত ক্রিকেট সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে।
উদাহরণস্বরূপ, Dream11 বর্তমানে ভারতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি স্পনসর, যার জন্য তারা ২০২৬ সাল পর্যন্ত ৩৫৮ কোটি টাকার চুক্তি করেছে। অন্যদিকে, My11Circle হলো ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (IPL)-এর অন্যতম প্রধান পার্টনার, যার জন্য তারা ২০২৮ সাল পর্যন্ত ৬২৫ কোটি টাকার চুক্তি করেছে । এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ায় BCCI, IPL এবং সম্প্রচারকারী সংস্থাগুলির (যেমন JioStar) রাজস্বে একটি বড় ঘাটতি তৈরি হবে। শুধু তাই নয়, ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত এন্ডোর্সমেন্টের বাজারও সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে । এর ফলে, যে শিল্পটি এতদিন ধরে ক্রিকেটের অর্থনীতিকে গতি দিচ্ছিল, তা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যাওয়ায় একটি বড় শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে।
আইনের লড়াই: ‘গেম অফ স্কিল’ বনাম ‘গেম অফ চান্স’ বিতর্ক কি শেষ?
নতুন আইনটি ‘গেম অফ স্কিল’ এবং ‘গেম অফ চান্স’-এর মধ্যেকার কয়েক দশক পুরোনো আইনি পার্থক্যকে মুছে দিয়েছে। এই পদক্ষেপটি একটি বড় সাংবিধানিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং ভারতীয় বিচারব্যবস্থার সামনে একটি নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় এবং তার তাৎপর্য
ভারতীয় আইন অনুসারে, জুয়া (gambling) নিষিদ্ধ, কিন্তু দক্ষতার খেলাকে ব্যবসা হিসেবে গণ্য করা হয় এবং সংবিধানের ১৯(১)(জি) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তা সুরক্ষিত । কোনো খেলা দক্ষতার না ভাগ্যের, তা নির্ধারণ করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট একাধিক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে।
মামলার নাম | বিচার্য বিষয় | রায় (দক্ষতা/ভাগ্য) | মূল নীতি |
State of Bombay v. RMD Chamarbaugawala (1957) | পুরস্কার প্রতিযোগিতা | দক্ষতা | যে প্রতিযোগিতায় দক্ষতার প্রাধান্য থাকে, তা জুয়া নয়, বরং একটি বৈধ ব্যবসায়িক কার্যকলাপ 33। |
State of AP v. K. Satyanarayana (1968) | রামি (Rummy) | দক্ষতা | রামি খেলাটি মূলত দক্ষতার উপর নির্ভরশীল, পুরোপুরি ভাগ্যের উপর নয় 32। |
Dr. KR Lakshmanan v. State of Tamil Nadu (1996) | ঘোড়দৌড়ে বাজি | দক্ষতা | ঘোড়দৌড়ের ফলাফল একাধিক দক্ষতার উপর নির্ভরশীল ফ্যাক্টর (যেমন ঘোড়া ও জকির দক্ষতা) বিচার করে অনুমান করা হয় 32। |
Varun Gumber v. U.T. of Chandigarh (2017) | ফ্যান্টাসি স্পোর্টস (Dream11) | দক্ষতা | ফ্যান্টাসি স্পোর্টসে সাফল্য ব্যবহারকারীর উচ্চতর জ্ঞান, বিচারক্ষমতা এবং মনোযোগের উপর নির্ভর করে 34। |
এই রায়গুলি স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল যে, যে খেলায় জেতার জন্য ভাগ্যের চেয়ে দক্ষতার প্রয়োজন বেশি, তা বৈধ। ফ্যান্টাসি স্পোর্টস প্ল্যাটফর্মগুলি এই আইনি কাঠামোর উপর ভিত্তি করেই ভারতে ব্যবসা পরিচালনা করছিল।
নতুন আইন কি সাংবিধানিক ভাবে বৈধ?
নতুন বিলটি এই প্রতিষ্ঠিত আইনি ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে। আইনটিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, নিষেধাজ্ঞাটি “খেলাটি দক্ষতা, ভাগ্য বা উভয়ের উপর ভিত্তি করে কিনা তা নির্বিশেষে” প্রযোজ্য হবে। এটি সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ‘প্রধান্য পরীক্ষা’ বা ‘predominance test’-এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
এছাড়াও, ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, ‘বেটিং এবং জুয়া’ রাজ্য তালিকার বিষয়, অর্থাৎ এই বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাজ্য সরকারগুলির হাতে রয়েছে । সেক্ষেত্রে, কেন্দ্রীয় সরকার কীভাবে দেশব্যাপী একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে, তা নিয়ে একটি বড় সাংবিধানিক প্রশ্ন উঠছে। এই দুটি প্রধান কারণে, গেমিং শিল্প সুপ্রিম কোর্টে এই আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। যদি তা হয়, তবে এটি ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতির ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি আইনি লড়াই হবে, যা কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক এবং ব্যবসার স্বাধীনতার মতো মৌলিক বিষয়গুলিকে প্রভাবিত করবে।
ভবিষ্যতের পথ: গেমিং সংস্থাগুলির সামনে এখন কী কী বিকল্প রয়েছে?
এই চরম সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে ভারতীয় গেমিং সংস্থাগুলি এখন টিকে থাকার জন্য নতুন পথের সন্ধান করছে। একদিকে যেমন অবৈধ বাজারের ঝুঁকি বাড়ছে, তেমনই অন্যদিকে নতুন ব্যবসায়িক মডেলের সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে।
নিষিদ্ধ অ্যাপের বিকল্প? অবৈধ অফশোর প্ল্যাটফর্মের রমরমা
সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা দেওয়া 5। কিন্তু শিল্প বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, এই নিষেধাজ্ঞার ফল উল্টো হতে পারে। ভারতে রিয়েল-মানি গেমিং-এর বিপুল চাহিদা রাতারাতি শেষ হয়ে যাবে না। বৈধ এবং নিয়ন্ত্রিত ভারতীয় প্ল্যাটফর্মগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, ব্যবহারকারীরা অবৈধ এবং অনিয়ন্ত্রিত বিদেশী বা অফশোর বেটিং ওয়েবসাইটগুলির দিকে ঝুঁকতে পারে ।
এই অফশোর প্ল্যাটফর্মগুলি ভারতের আইন মেনে চলে না, সরকারকে কোনো কর দেয় না এবং সেখানে ব্যবহারকারীদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। KYC (Know Your Customer) নিয়ম না থাকায় এগুলি অর্থ পাচারের জন্য ব্যবহার করা হতে পারে, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য আরও বড় হুমকি সৃষ্টি করবে । অর্থাৎ, একটি সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে সরকার হয়তো অজান্তেই একটি আরও বড় এবং অনিয়ন্ত্রিত কালোবাজার তৈরি করে দিচ্ছে।
ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই: Free-to-Play এবং সাবস্ক্রিপশন মডেল
টিকে থাকার জন্য সংস্থাগুলি তাদের ব্যবসায়িক মডেলে দ্রুত পরিবর্তন আনছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় বিকল্পটি হলো ‘ফ্রি-টু-প্লে’ (Free-to-Play বা F2P) মডেল। এই মডেলে ব্যবহারকারীরা বিনামূল্যে গেম খেলতে পারে, এবং সংস্থাগুলি বিজ্ঞাপন বা ইন-অ্যাপ পারচেজ (যেমন গেমে ব্যবহারের জন্য ভার্চুয়াল আইটেম বিক্রি) থেকে আয় করে ।
আরেকটি সম্ভাব্য মডেল হলো সাবস্ক্রিপশন-ভিত্তিক পরিষেবা, যেখানে ব্যবহারকারীরা মাসিক বা বার্ষিক চাঁদার বিনিময়ে বিভিন্ন গেম খেলতে পারবেন 30। যদিও এই মডেলগুলি রিয়েল-মানি গেমিং-এর মতো লাভজনক নয়, তবুও এগুলি সংস্থাগুলিকে টিকে থাকতে এবং তাদের বিশাল ব্যবহারকারী বেস ধরে রাখতে সাহায্য করতে পারে।
শুধু গেমিং নয়, ফিনটেক থেকে ই-স্পোর্টস—নূতনের সন্ধান
এই সংকট কিছু সংস্থাকে সম্পূর্ণ নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে বাধ্য করছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো Dream11-এর মূল সংস্থা Dream Sports। তারা সম্প্রতি ‘Dream Money’ নামে একটি ফিনটেক অ্যাপ চালু করেছে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা সোনায় বিনিয়োগ করতে এবং তাদের খরচ ট্র্যাক করতে পারবেন 36। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তারা তাদের কোটি কোটি ব্যবহারকারীর বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে গেমিং-এর বাইরে একটি সম্পূর্ণ নতুন এবং নিয়ন্ত্রিত শিল্পে প্রবেশ করছে। এই প্রবণতা যদি বাড়তে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে এই গেমিং সংস্থাগুলি বৈচিত্র্যময় ‘সুপার-অ্যাপ’-এ পরিণত হতে পারে।
পাশাপাশি, এই বিলের একটি ইতিবাচক দিকও রয়েছে। সরকার ই-স্পোর্টস এবং সোশ্যাল বা শিক্ষামূলক গেমিংকে সক্রিয়ভাবে প্রচার করার কথা বলেছে 8। এটি NODWIN Gaming বা Nazara Technologies-এর মতো সংস্থাগুলির জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছে, যারা প্রতিযোগিতামূলক গেমিং বা ই-স্পোর্টস নিয়ে কাজ করে। এর ফলে, বিনিয়োগের অভিমুখ রিয়েল-মানি গেমিং থেকে সরে ই-স্পোর্টসের দিকে যেতে পারে, যা এই ক্ষেত্রটির বিকাশে সাহায্য করবে।
উপসংহার: ব্যবহারকারী এবং শিল্পের জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ
‘The Promotion and Regulation of Online Gaming Bill, 2025’ ভারতীয় ডিজিটাল জগতে একটি ভূমিকম্পের মতো এসেছে। এই আইনটি শুধুমাত্র কয়েকটি অ্যাপ বন্ধ করেনি, বরং একটি সম্পূর্ণ শিল্পকে তার অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। এই প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলি সংক্ষেপে হলো:
- সরকার সামাজিক সুরক্ষার কারণ দেখিয়ে ‘গেম অফ স্কিল’ এবং ‘গেম অফ চান্স’-এর পার্থক্য না করে সমস্ত অনলাইন মানি গেম নিষিদ্ধ করেছে।
- এর ফলে, WinZO, Dream11, MPL: এখন কাজ করছে না এমন অনলাইন মানি গেমিং প্ল্যাটফর্মের সম্পূর্ণ তালিকা-তে প্রায় সমস্ত বড় নামই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যদিও সংস্থাগুলি ব্যবহারকারীদের টাকা সুরক্ষিত থাকার আশ্বাস দিয়েছে।
- এই নিষেধাজ্ঞার ফলে লক্ষ লক্ষ চাকরি, হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং ক্রীড়া জগতের স্পনসরশিপ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
- আইনটি সুপ্রিম কোর্টের পূর্ববর্তী রায়কে চ্যালেঞ্জ করায় একটি বড় সাংবিধানিক লড়াইয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
- টিকে থাকার জন্য সংস্থাগুলি ফ্রি-টু-প্লে, সাবস্ক্রিপশন এবং ফিনটেকের মতো নতুন ব্যবসায়িক মডেলের দিকে ঝুঁকছে, যখন ই-স্পোর্টস একটি নতুন সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে উঠে আসছে।
ব্যবহারকারীদের জন্য পরামর্শ হলো, আপাতত অ্যাপগুলির ওয়ালেট থেকে বাকি টাকা তুলে নেওয়া এবং কোনো ধরনের অবৈধ অফশোর প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে থাকা। ভারতীয় গেমিং শিল্পের জন্য এটি একটি বেদনাদায়ক পরিবর্তন, কিন্তু এই সংকট হয়তো একটি নতুন, আরও বৈচিত্র্যময় এবং স্থিতিশীল ডিজিটাল বিনোদন ইকোসিস্টেমের জন্ম দিতে পারে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আপনার মতামত কী? কমেন্টে আমাদের জানান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনটি অন্যদের সাথে শেয়ার করুন।