মেয়েদের শরীর পুরুষদের তুলনায় বেশি গরম থাকার পেছনে রয়েছে জটিল শারীরবৃত্তীয় ও হরমোনজনিত কারণ। বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী, ইউনিভার্সিটি অব উটাহর একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে নারীদের কোর বডি টেম্পারেচার পুরুষদের থেকে গড়ে ০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বেশি। তবে বিরোধাভাসে, নারীদের হাতের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কম থাকে – গড়ে ৮২.৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট, যেখানে পুরুষদের হাতের তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
হরমোনের প্রভাব: ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের ভূমিকা
ইস্ট্রোজেনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
ইস্ট্রোজেন হরমোন নারীদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই হরমোন মস্তিষ্কের যে অংশ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, সেটিকে প্রভাবিত করে এবং সাধারণত শরীরের তাপমাত্রা কমানোর দিকে কাজ করে। ইস্ট্রোজেন রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে, বিশেষ করে হাত ও পায়ের প্রান্তীয় অংশে, যার ফলে বেশি তাপ বাইরের পরিবেশে নির্গত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে যে অভিউলেশনের আগের পর্যায়ে, যখন ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বেশি থাকে, তখন নারীদের সার্বিক ২৪ ঘণ্টার তাপমাত্রা কমে যায়। একটি এনসিবিআই গবেষণায় দেখা গেছে যে ইস্ট্রোজেনের উপস্থিতিতে প্রোজেস্টেরনের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী প্রভাব কমে যায়।
প্রোজেস্টেরনের থার্মোজেনিক প্রভাব
প্রোজেস্টেরন হরমোনের রয়েছে শক্তিশালী তাপ উৎপাদনকারী (থার্মোজেনিক) বৈশিষ্ট্য। মাসিক চক্রের লুটিয়াল ফেজে (অভিউলেশনের পর), যখন প্রোজেস্টেরনের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন নারীদের কোর বডি টেম্পারেচার ০.৩ থেকে ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
একটি বিশেষজ্ঞ গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রোজেস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধির প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এই বৃদ্ধি মাসিক শুরু হওয়া পর্যন্ত বজায় থাকে।
শারীরিক গঠন ও মেটাবলিজমের প্রভাব
মাংসপেশি ও চর্বির অনুপাত
নারী ও পুরুষের শরীরের গঠনগত পার্থক্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পুরুষদের তুলনায় নারীদের কম মাংসপেশি থাকে, যা প্রাকৃতিক তাপ উৎপাদনকারী। পাশাপাশি নারীদের পুরুষদের তুলনায় ৬ থেকে ১১ শতাংশ বেশি চর্বি রয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে উষ্ণ রাখে কিন্তু ত্বক ও প্রান্তীয় অংশে তাপ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে।
মেটাবলিক রেটের পার্থক্য
জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড ফিজিওলজিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে নারীদের রেস্টিং মেটাবলিক রেট পুরুষদের তুলনায় ২৩ শতাংশ কম। কম মেটাবলিক রেট মানে কম তাপ উৎপাদন, যার ফলে নারীরা পুরুষদের তুলনায় দ্রুত ঠান্ডা অনুভব করেন।
এই কারণেই পুরুষদের প্রায়ই “হাঁটা স্পেস হিটার” বলা হয়, কারণ তারা নিজেদের চারপাশে ছোট তাপের দ্বীপ তৈরি করে। তাদের বেশি মাংসপেশি বেশি ক্যালোরি ব্যবহার করে তাপ উৎপাদন করে, যা ত্বক, কাপড় এবং শরীরের উপরিভাগের বাতাসকে গরম করে।
রক্ত সঞ্চালন ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
রক্তনালীর প্রসারণ ও সংকোচন
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মূল নিয়ামক হলো রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা। যখন শরীর গরম লাগে, রক্তনালী প্রসারিত হয়ে বেশি রক্ত ত্বকের কাছে প্রবাহিত করে, যার ফলে অতিরিক্ত তাপ নির্গত হয়। ঠান্ডার সময় রক্তনালী সংকুচিত হয়ে রক্তকে মূল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাছে রাখে।
নারীদের হরমোনাল প্রভাবে এই প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে ওঠে। ইস্ট্রোজেন প্রান্তীয় রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে, যার ফলে বেশি তাপ হারিয়ে যায়। অন্যদিকে প্রোজেস্টেরন ত্বকের রক্তনালীগুলোকে সংকুচিত করে, রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয়।
রেইনড’স ডিজিজের প্রভাব
নারীরা রেইনড’স ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি পুরুষদের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। এই রোগে প্রান্তীয় অংশে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালীগুলো ঠান্ডা বা চাপের প্রতিক্রিয়ায় অত্যধিক সংকুচিত হয়ে যায়। ফলে হাত ও পায়ের আঙুলগুলো প্রথমে সাদা, তারপর নীল হয়ে যায়।
ঘাম উৎপাদন ও তাপ নিষ্কাশন
ঘামের পরিমাণে লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য
গবেষণায় দেখা গেছে যে নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম ঘামেন, কিন্তু তাদের ঘামের কার্যকারিতা বেশি। একটি ফিজিওলজি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে যে একই পরিমাণ মেটাবলিক তাপ উৎপাদনের জন্য নারীদের ঘামের ক্ষমতা পুরুষদের তুলনায় কম।
তবে এই কম ঘাম উৎপাদন সবসময় অসুবিধার কারণ নয়। উচ্চ আর্দ্রতাযুক্ত পরিবেশে, যেখানে ঘাম বাষ্পীভূত হতে পারে না এবং শুধু ঝরে পড়ে, নারীদের কম ঘাম উৎপাদন আসলে সুবিধাজনক কারণ এতে অতিরিক্ত তরল হারানো হয় না।
পরিবেশগত অভিযোজন
১৯৬৫ সালের একটি ক্লাসিক গবেষণায় দেখা গেছে যে নারী ও পুরুষ বিভিন্ন পরিবেশে ভিন্নভাবে অভিযোজিত হয়। গরম ও আর্দ্র পরিবেশে নারীরা ভাল কার্যক্ষমতা দেখায়, যেখানে গরম ও শুষ্ক পরিবেশে পুরুষরা বেশি সহনশীল।
মাসিক চক্রের প্রভাব
ফলিকুলার ও লুটিয়াল ফেজের পার্থক্য
মাসিক চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীদের শরীরের তাপমাত্রায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। ফলিকুলার ফেজে (মাসিকের শুরু থেকে অভিউলেশন পর্যন্ত) নারীদের তাপমাত্রা পুরুষদের অনুরূপ থাকে। কিন্তু লুটিয়াল ফেজে (অভিউলেশনের পর থেকে পরবর্তী মাসিক পর্যন্ত) তাপমাত্রা স্পষ্টভাবে বৃদ্ধি পায়।
এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি এতটাই নির্ভরযোগ্য যে নারীরা একে অভিউলেশন ট্র্যাকিং এবং গর্ভধারণের পরিকল্পনার জন্য ব্যবহার করেন। আধুনিক পরিধানযোগ্য তাপমাত্রা সেন্সরগুলো এই নীতিতেই কাজ করে।
গর্ভাবস্থায় তাপমাত্রার ধারাবাহিকতা
গর্ভধারণের ক্ষেত্রে, লুটিয়াল ফেজের উচ্চ তাপমাত্রা কর্পাস লুটিয়ামের সমগ্র জীবনকাল জুড়ে বজায় থাকে। এটি গর্ভাবস্থার প্রাথমিক সনাক্তকরণের একটি প্রাকৃতিক উপায়।
আধুনিক গবেষণার ফলাফল
বৃহৎ পরিসরের জনসংখ্যাগত গবেষণা
৩৫,৪৮৮ জন রোগীর উপর পরিচালিত একটি বৃহৎ গবেষণায় (গড় বয়স ৫২.৯ বছর, ৬৪% নারী, ৪১% অ-শ্বেতাঙ্গ) ২৪৩,৫০৬টি তাপমাত্রা পরিমাপের মাধ্যমে দেখা গেছে যে গড় শরীরের তাপমাত্রা ৩৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আফ্রিকান-আমেরিকান নারীদের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ পাওয়া গেছে (শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের তুলনায় ০.০৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি)।
নতুন পদ্ধতিগত গবেষণা
২০২৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে মাসিক চক্র সত্ত্বেও নারীদের তাপমাত্রার পরিবর্তনশীলতা পুরুষদের তুলনায় বেশি নয়। বরং মাসিক চক্রের পূর্বাভাসযোগ্য ছন্দ নারীদের তাপমাত্রাকে পুরুষদের তুলনায় আরও সহজে পূর্বাভাস দেওয়া যায়।
স্বাস্থ্যগত প্রভাব ও জটিলতা
হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য ও রক্তচাপ
তরুণ নারীদের ইস্ট্রোজেন-মধ্যস্থ প্রান্তীয় রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি তাদের রক্তচাপ কম রাখতে সাহায্য করে। তবে এই একই বৈশিষ্ট্য তাদের পোস্চারাল ট্যাকিকার্ডিয়া সিনড্রোম এবং অর্থোস্ট্যাটিক হাইপোটেনশনের ঝুঁকি ৫:১ অনুপাতে বাড়িয়ে দেয়।
ব্যায়াম ও তাপ সহনশীলতা
গবেষণায় দেখা গেছে যে ৪,৫০০ সুস্থ সৈনিকের উপর ১০ বছরের গবেষণায় এক্সারশনাল হিট স্ট্রোকের (EHS) ঝুঁকি নারী ও পুরুষের মধ্যে সমান। এটি প্রমাণ করে যে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য সত্ত্বেও সামগ্রিক তাপ সহনশীলতায় কোনো লিঙ্গভিত্তিক অসুবিধা নেই।
পরিবেশগত কারণ ও জলবায়ু পরিবর্তন
কর্মক্ষেত্রে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রের থার্মোস্ট্যাট ১৯৬০-এর দশকে তৈরি একটি মডেলের ভিত্তিতে সেট করা হয়, যা শুধুমাত্র পুরুষদের মেটাবলিক মাত্রা বিবেচনা করে এবং নারীদের মেটাবলিক রেট ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত অতিমূল্যায়ন করতে পারে। এই কারণে অফিসে নারীরা প্রায়ই ঠান্ডা অনুভব করেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) গবেষণা অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়তি তাপমাত্রায় নারীরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। ২০০৩ সালের ইউরোপীয় তাপপ্রবাহে পুরুষদের তুলনায় বেশি নারী মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তবে আমেরিকায় বয়স্ক পুরুষরা তাপপ্রবাহে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহারিক সমাধান
ব্যক্তিগত তাপমাত্রা ব্যবস্থাপনা
যেহেতু নারী ও পুরুষের তাপমাত্রার পছন্দ ভিন্ন, “স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্লিপ মেথড” (আলাদা কম্বল ব্যবহার) এর মতো কৌশল সহায়ক হতে পারে। কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কমফোর্ট সিস্টেম যেমন ছোট ডেস্ক ফ্যান, হিটেড চেয়ার, এবং ফুট ওয়ার্মার ব্যবহার করা যেতে পারে।
ভবিষ্যৎ গবেষণার দিকনির্দেশনা
আধুনিক গবেষকরা এখন যৌন হরমোন যেমন ইস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টেরনের এই পার্থক্যগুলোতে কী ভূমিকা রয়েছে এবং বয়সের সাথে হরমোনাল পরিবর্তন কীভাবে মেটাবলিক রোগের ঝুঁকিকে প্রভাবিত করে, সে বিষয়ে গবেষণা করছেন।
ভবিষ্যতের গবেষণা ও প্রয়োগ
চিকিৎসা গবেষণায় এই ফলাফলগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত ডায়াবেটিসের ঝুঁকি পূর্বাভাস দিতে এবং নারী ও পুরুষের জন্য আলাদাভাবে ব্যায়াম থেরাপির সুপারিশ করতে এই জ্ঞান কাজে লাগবে।