স্টাফ রিপোর্টার
১৪ মার্চ ২০২৫, ৫:৩৪ অপরাহ্ণ
অনলাইন সংস্করণ

কলকাতা হাইকোর্টে ইতিহাস গড়লেন মহিলা বিচারপতিরা: ১৬৩ বছরে প্রথমবার ৮ জনের উপস্থিতি

কলকাতা হাইকোর্টে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত দেখা গেছে সম্প্রতি, যখন এই প্রাচীন আদালতের ১৬৩ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার মহিলা বিচারপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ জনে। এই ঘটনা কেবল সংখ্যার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি ভারতের বিচারব্যবস্থায় নারীদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণের একটি প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। গত মঙ্গলবার তিনজন নতুন অতিরিক্ত বিচারপতির শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই মাইলফলক স্পর্শ করা সম্ভব হয়েছে, যার মধ্যে একজন মহিলা বিচারপতিও রয়েছেন। এই ঘটনা আইনজীবীদের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছে এবং নারীদের জন্য বিচারব্যবস্থায় আরও সুযোগের দ্বার উন্মোচন করেছে।

গত ১১ মার্চ, ২০২৫-এ কলকাতা হাইকোর্টে তিনজন অতিরিক্ত বিচারপতি শপথ নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি স্মিতা দাস দে, যিনি নতুন করে যোগ দিয়ে মহিলা বিচারপতির সংখ্যা বাড়িয়েছেন। এর আগে এই আদালতে সাতজন মহিলা বিচারপতি কর্মরত ছিলেন—বিচারপতি অমৃতা সিনহা, শম্পা সরকার, সুভ্রা ঘোষ, অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়, চৈতালি চট্টোপাধ্যায় (দাস), শম্পা দত্ত (পাল) এবং রাই চট্টোপাধ্যায়। নতুন এই সংযোজনের ফলে মোট আটজন মহিলা বিচারপতি একসঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টে দায়িত্ব পালন করছেন, যা এই আদালতের দীর্ঘ ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এই তিনজনের শপথ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আদালতের বিচারপতির সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ জনে, যদিও এর অনুমোদিত শক্তি ৭২।

এই ঘটনার বিস্তারিত দিকগুলো জানতে গেলে বোঝা যায়, কলকাতা হাইকোর্টে নারী বিচারপতিদের উপস্থিতি ধীরে ধীরে বাড়ছে। ১৮৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই আদালত ভারতের প্রাচীনতম হাইকোর্ট হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘ এই সময়ে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত থাকলেও গত কয়েক বছরে পরিবর্তনের হাওয়া লক্ষ্য করা গেছে। ২০২২ সালে প্রথমবার এই আদালতে ছয়জন মহিলা বিচারপতি একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। এবার সেই সংখ্যা আরও বেড়ে ৮-এ পৌঁছেছে। শপথ গ্রহণের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম, যিনি নতুন বিচারপতিদের স্বাগত জানান। অন্য দুজন নতুন বিচারপতি হলেন রীতোব্রত কুমার মিত্র এবং ওম নারায়ণ রাই।

কলকাতা হাইকোর্টের এই অর্জন অন্যান্য হাইকোর্টের সঙ্গে তুলনা করলে আরও কিছু তথ্য সামনে আসে। ভারতের মোট ২৫টি হাইকোর্টের মধ্যে মাদ্রাস এবং পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে ১৩ জন করে মহিলা বিচারপতি রয়েছেন, যা সর্বোচ্চ। বোম্বে হাইকোর্টে রয়েছেন ১১ জন। কলকাতা হাইকোর্ট এখন এই তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে। তবে ত্রিপুরা এবং উত্তরাখণ্ডের মতো কিছু হাইকোর্টে এখনও একজনও মহিলা বিচারপতি নেই। ২০২৩ সালের জুন মাসের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের হাইকোর্টগুলোতে মোট ৭৮৮ জন বিচারপতির মধ্যে মাত্র ১০৭ জন (১৩%) মহিলা। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, বিচারব্যবস্থায় নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

মহিলা বিচারপতিদের এই ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি আইন পেশায় নারীদের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করে। বিচারপতি স্মিতা দাস দে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেছেন, তিনি একটি ডাক্তার পরিবার থেকে এসেও আইন পেশা বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর প্রাথমিক জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জ এলেও মায়ের সমর্থন তাঁকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আইনজীবী সমাজের সিনিয়ররাও এই ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। ইনকর্পোরেটেড ল সোসাইটির সেক্রেটারি পরিতোষ সিনহা বলেন, “এটি একটি সঠিক পদক্ষেপ। এতে ভারসাম্য রক্ষা হয় এবং নতুন আইনজীবীদের উৎসাহিত করে।” আবার, সিনিয়র কাউন্সেল অমৃতা পাণ্ডে মনে করেন, মহিলা বিচারপতিদের উপস্থিতি নারী মক্কেল বা আইনজীবীদের ব্যক্তিগত সমস্যা বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক।

এই ঘটনা কেবল সংখ্যার খেলা নয়, বরং একটি সামাজিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। কলকাতা হাইকোর্টে মহিলা বিচারপতিদের সংখ্যা বৃদ্ধি ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় লিঙ্গ সমতার দিকে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই অগ্রগতি আরও বাড়াতে হলে নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি। কারণ, হাইকোর্টের বিচারপতিরা সাধারণত নিম্ন আদালত বা বার থেকে উঠে আসেন। এই প্রেক্ষাপটে, কলকাতা হাইকোর্টের এই অর্জন অন্যান্য আদালতের জন্যও অনুপ্রেরণা হতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, এই ঘটনা ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় নারীদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কলকাতা হাইকোর্টের ১৬৩ বছরের ইতিহাসে এমন মুহূর্ত বিরল। এটি কেবল একটি শুরু, যা ভবিষ্যতে আরও বড় পরিবর্তনের পথ দেখাতে পারে। নারীদের এই অগ্রযাত্রা আইনের শাসনকে আরও শক্তিশালী ও সাম্যের দিকে নিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সম্ভাবনা! লালবাজার থেকে এল চিঠি

উচ্চমাধ্যমিকের খাতা: আংশিক শিক্ষকদের হাতে মূল্যায়ন, উঠছে প্রশ্ন সঠিকতা নিয়ে!

অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের দ্বারোদঘাটন: এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত

একাদশে ফেল করলেও দ্বাদশে ভর্তির সুযোগ, নতুন নিয়মে চমক দিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার!

কলকাতা হাইকোর্টে ইতিহাস গড়লেন মহিলা বিচারপতিরা: ১৬৩ বছরে প্রথমবার ৮ জনের উপস্থিতি

বায়ুদূষণের ছায়ায় ভারত: বিশ্বে পঞ্চম, দিল্লিসহ ১৩ শহর শীর্ষে!

স্যালারি অ্যাকাউন্টের গোপন সুবিধা এবং সতর্কতা: যা জানা আপনার জন্য জরুরি

হলমার্ক নাকি কেডিএম: খাঁটি সোনার গয়না কেনার সময় কোনটি বেশি বিশ্বস্ত?

পরীমনি কি ঢালিউডের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত নায়িকা? জানুন তাঁর আয়ের হিসেব

iQOO Neo 10R Pros & Cons: সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ এবং ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা

১০

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে ‘আজাদ কাশ্মীর’ লিখে ঝড়: কারা এই PDSF?

১১

কর্মফল ত্যাগে মুক্তির পথ: ভগবদ গীতায় কর্মের দর্শন

১২

ধর্মের পথে গীতার আলো: জীবনবোধের অমৃত বাণী

১৩

ইলেকট্রিক গাড়ির চার্জ নিয়ে দুশ্চিন্তার দিন শেষ! ব্রিটিশ ফার্মের সঙ্গে হাত মেলাতে চলেছে CESC

১৪

রাজনীতির মাঠ থেকে ওটিটি পর্দায়: সিপিএম নেত্রী দীপ্সিতা ধর এখন ‘জিদ্দি গার্লস’-এর বিদ্রোহী চরিত্রে!

১৫

ভারতে খুচরা মুদ্রাস্ফীতি ৩.৬১ শতাংশে নেমেছে: সবজির দাম কমায় জনগণের স্বস্তি

১৬

রেশন কার্ডে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট যুক্ত করার প্রস্তাব: কেন্দ্রের পথে রাজ্যের সমর্থন!

১৭

আইপিএলের ছক্কার রাজা কে? টুর্নামেন্ট শুরুর আগে দেখে নিন শীর্ষ দশের তালিকা

১৮

মাহমুদউল্লাহর ক্রিকেট যাত্রার ইতি: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিদায়ের ঘোষণা

১৯

অষ্টম বেতন কমিশন: সরকারি কর্মচারীদের জন্য সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম ডিএ বৃদ্ধির সম্ভাবনা, হতাশার ছায়া!

২০
close