বিশ্বের প্রাচীন জঙ্গলগুলি শুধু প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টিই নয়, বরং পৃথিবীর ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। এই অরণ্যগুলি আমাদের গ্রহের জৈব বৈচিত্র্যের ধারক ও বাহক, যা আমাদের পরিবেশ ও জীবনের জন্য অপরিহার্য। আসুন, একজন অভিজ্ঞ ভ্রমণকারী হিসেবে বিশ্বের দশটি প্রাচীনতম জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একটি অসাধারণ যাত্রায় বের হই।
দাইয়ান্টিয়ান শান জঙ্গল, চীন:
চীনের ইউনান প্রদেশে অবস্থিত দাইয়ান্টিয়ান শান জঙ্গল বিশ্বের প্রাচীনতম জঙ্গল হিসেবে পরিচিত। প্রায় 370 মিলিয়ন বছর পুরনো এই জঙ্গল ডেভোনিয়ান যুগের জীবাশ্ম উদ্ভিদের বাসস্থান। এখানে রয়েছে বিরল গিংকো গাছ, যা “জীবন্ত জীবাশ্ম” হিসেবে পরিচিত। জঙ্গলটি UNESCO ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত, যা এর ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক গুরুত্বকে তুলে ধরে।
ইয়াসুনি ন্যাশনাল পার্ক, ইকুয়েডর:
ইকুয়েডরের অ্যামাজন অঞ্চলে অবস্থিত ইয়াসুনি ন্যাশনাল পার্ক বিশ্বের সবচেয়ে জৈব বৈচিত্র্যপূর্ণ স্থানগুলির মধ্যে একটি। এই পার্কে প্রতি হেক্টরে গাছের প্রজাতির সংখ্যা পুরো উত্তর আমেরিকার চেয়েও বেশি। এখানে রয়েছে 150টিরও বেশি অ্যাম্ফিবিয়ান প্রজাति, যা ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেনের মোট প্রজাতির চেয়েও বেশি। তবে, তেল অনুসন্ধান ও খনন এই অমূল্য পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
টংগাস-শামান জঙ্গল, রাশিয়া:
সাইবেরিয়ায় অবস্থিত টংগাস-শামান জঙ্গল বিশ্বের বৃহত্তম অক্ষত বোরিয়াল জঙ্গল। এই জঙ্গল কার্বন সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বাস করে বিরল সাইবেরিয়ান টাইগার ও অন্যান্য দুর্লভ প্রজাতি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়তে থাকা তাপমাত্রা এই জঙ্গলের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গণ্ডোয়ানা রেইনফরেস্ট, অস্ট্রেলিয়া:
কুইন্সল্যান্ডে অবস্থিত গণ্ডোয়ানা রেইনফরেস্ট প্রায় 180 মিলিয়ন বছর পুরনো। এটি সুপারকন্টিনেন্ট গণ্ডোয়ানার অবশিষ্টাংশ, যা এর নামকরণের উৎস। এখানে রয়েছে অনেক প্রাচীন উদ্ভিদ প্রজাति, যেমন ওয়লেমি পাইন, যা ডাইনোসরের যুগেও বিদ্যমান ছিল। এই জঙ্গল UNESCO ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত।
ডারিয়েন গ্যাপ, পানামা/কলম্বিয়া:
দক্ষিণ ও মধ্য আমেরिকার মধ্যে অবস্থিত ডারিয়েন গ্যাপ একটি অনন্য পরিবেশ তন্ত্র। এই অঞ্চলে রয়েছে বিশাল জৈব বৈচিত্র্য, যার মধ্যে রয়েছে হারপি ঈগল ও জাগুয়ারের মতো বিরল প্রজাতি। তবে, অবৈধ কাঠ সংগ্রহ ও ভূমি অধিগ্রহণ এই অমূল্য পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে। UNESCO এই অঞ্চলকে বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হिসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
টাইগা জঙ্গল, কানাডা:
কানাডার বোরিয়াল জঙ্গল, যা টাইগা নামেও পরিচিত, বিশ্বের বৃহত্তম অক্ষত বনভূমি। এই জঙ্গল বিশ্বের মিঠা পানির এক-তৃতীয়াংশের আধার এবং বিপুল পরিমাণ কার্বন সঞ্চয় করে রাখে। এখানে বাস করে ক্যারিবু, গ্রিজলি বিয়ার, ও উলফের মতো প্রজাতি। জলবায়ু পরিবর্তন ও তেল-গ্যাস খনন এই জঙ্গলের জন্য বড় হুমকি।
আমাজন রেইনফরেস্ট, দক্ষিণ আমেরিকা:
বিশ্বের বৃহত্তম ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্ট আমাজন, যা নয়টি দেশ জুড়ে বিস্তৃত। এই জঙ্গল পৃথিবীর অক্সিজেনের 20% উৎপাদন করে এবং অসংখ্য প্রজাতির বাসস্থান। তবে, বননিধন ও জলবায়ু পরিবর্তন এর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই হারে বনধ্বংস চলতে থাকলে 2064 সালের মধ্যে আমাজন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
ডেইনট্রি রেইনফরেস্ট, অস্ট্রেলিয়া:
কুইন্সল্যান্ডে অবস্থিত ডেইনট্রি রেইনফরেস্ট বিশ্বের প্রাচীনতম ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্টগুলির মধ্যে একটি, যার বয়স প্রায় 180 মিলিয়ন বছর। এটি UNESCO ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত। এখানে রয়েছে অনেক বিরল ও স্থানীয় প্রজাতি, যেমন ক্যাসোয়ারি পাখি ও ট্রি-ক্যাঙ্গারু। জলবায়ু পরিবর্তন ও পর্যটন এই অনন্য পরিবেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কঙ্গো বেসিন রেইনফরেস্ট, মধ্য আফ্রিকা:
আফ্রিকার “সবুজ হৃদয়” হিসেবে পরিচিত কঙ্গো বেসিন রেইনফরেস্ট বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ট্রপিক্যাল জঙ্গল। এটি ছয়টি দেশ জুড়ে বিস্তৃত এবং প্রায় 10,000 প্রজাতির উদ্ভিদ, 1,000 প্রজাতির পাখি, এবং 400 প্রজাতির স্তন্যপায়ীর আবাসস্থল। এখানে বাস করে বিরল মাউন্টেন গরিলা ও বোনোবো। অবৈধ শিকার, খনন, ও বনধ্বংস এই অমূল্য পরিবেশের জন্য বড় হুমকি।
রেড্উড ন্যাশনাল ও স্টেট পার্কস, যুক্তরাষ্ট্র:
ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত রেড্উড জঙ্গল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু গাছের আবাসস্থল। এখানকার কোস্ট রেড্উড গাছগুলি 2,000 বছরেরও বেশি পুরনো এবং 100 মিটারেরও বেশি উঁচু হতে পারে। এই জঙ্গল UNESCO ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত। জলবায়ু পরিবর্তন ও শহরায়ন এই অনন্য পরিবেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এই প্রাচীন জঙ্গলগুলি শুধু প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টিই নয়, এগুলি আমাদের গ্রহের স্বাস্থ্যের জন্যও অপরিহার্য। তবে, মানবীয় ক্রিয়াকলাপ ও জলবায়ু পরিবর্তন এদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আমাদের দায়িত্ব এই অমূল্য সম্পদগুলিকে সংরক্ষণ করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এদের সৌন্দর্য ও গুরুত্ব উপভোগ করতে পারে।