শুধু নেপালে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মালালা ইউসুফজাই-এর মতোই অসংখ্য তরুণী নারী আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছেন। প্রতিটি মহাদেশে, প্রতিটি দেশে এইসব সাহসী মেয়েরা নিজেদের এবং সমাজের অধিকারের জন্য লড়াই করে চলেছেন। শিক্ষা, পরিবেশ, বন্দুক নিয়ন্ত্রণ, অভিবাসী অধিকার থেকে শুরু করে জাতিগত সমতা পর্যন্ত – বিভিন্ন ইশ্যুতে এই তরুণীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
মালালার মতোই, সুইডেনের ১৫ বছর বয়সী গ্রেটা থুনবার্গ জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে শুরু করেছিলেন নিজের একক প্রতিবাদ দিয়ে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে, গ্রেটা সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে একাকী দাঁড়িয়ে ‘স্কুল স্ট্রাইক ফর ক্লাইমেট’ সাইনবোর্ড নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন। তার এই একাকী প্রতিবাদ থেকেই জন্ম নেয় ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ আন্দোলন, যা এখন বিশ্বের ১৩৫টি দেশের ২২ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করেছে। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে তার ‘হাউ ডেয়ার ইউ’ বক্তব্যটি বিশ্বব্যাপী আলোচনায় এসেছে।
আমেরিকার ফ্লোরিডার পার্কল্যান্ড স্কুল শুটিং থেকে বেঁচে আসা এমা গনজালেজ বন্দুক নিয়ন্ত্রণের জন্য অভূতপূর্ব আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৭ জন সহপাঠীকে হারানোর পর, তিনি ‘উই কল বিএস’ স্লোগান দিয়ে রাজনীতিবিদদের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তার নেতৃত্বে ‘মার্চ ফর আওয়ার লাইভস’ প্রতিবাদ আমেরিকান ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন হয়ে ওঠে, যেখানে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করে।
উগান্ডার ভানেসা নাকাতে আফ্রিকান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। গ্রেটা থুনবার্গের অনুপ্রেরণায় ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে কাম্পালায় একাকী জলবায়ু ধর্মঘট শুরু করে তিনি ‘ইয়ুথ ফর ফিউচার আফ্রিকা’ এবং ‘রাইজ আপ মুভমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। কঙ্গোর রেইনফরেস্ট রক্ষার জন্য তার প্রচারণা আফ্রিকা থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছে।
আমেরিকার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আমারিয়ানা ‘মারি’ কোপেনি মাত্র ৮ বছর বয়সে ফ্লিন্ট পানি সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে একটি চিঠি লিখে ফ্লিন্টে আসার জন্য অনুরোধ করেন, যার ফলস্বরূপ ওবামা ফ্লিন্ট সফর করেন এবং ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার অনুমোদন দেন। ‘লিটল মিস ফ্লিন্ট’ নামে পরিচিত এই তরুণী এ পর্যন্ত ৭০ লাখ ডলারের বেশি অর্থ সংগ্রহ করে সম্প্রদায়িক প্রকল্পগুলিতে কাজ করেছেন।
মেক্সিকান অভিবাসী পিতামাতার কন্যা সোফি ক্রুজ মাত্র ৫ বছর বয়সে অভিবাসীদের অধিকারের জন্য আওয়াজ তুলেছিলেন। ২০১৫ সালে পোপ ফ্রান্সিসের সাথে সাক্ষাতের জন্য তিনি নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে তার কাছে চিঠি পৌঁছে দেন, যা পোপকে কংগ্রেসে অভিবাসী সমস্যা নিয়ে কথা বলতে অনুপ্রাণিত করে। পরবর্তীতে ৬ বছর বয়সে তিনি ওয়াশিংটনের উইমেনস মার্চে লাখো মানুষের সামনে ইংরেজি ও স্প্যানিশ উভয় ভাষায় বক্তব্য রাখেন।
তান্ডিওয়ে আবদুল্লাহ ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মাত্র ৯ বছর বয়স থেকে এই আন্দোলনে জড়িত তিনি ২০১৫ সালে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার ইয়ুথ ভ্যানগার্ড’ সহ-প্রতিষ্ঠা করেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের পাবলিক স্কুল থেকে র্যান্ডম সার্চ এবং স্কুল পুলিশ সরানোর লড়াইয়ে তিনি সফলতা অর্জন করেছেন।
বাংলাদেশের রিমা সুলতানা রিমু ইয়াং উইমেন লিডার্স ফর পিস কার্যক্রমের সদস্য হিসেবে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে নারী ও শিশুদের শিক্ষামূলক সহায়তা প্রদান করে আসছেন। তিনি রেডিও সম্প্রচার এবং থিয়েটার পারফরমেন্সের মাধ্যমে নারী অধিকার ও শিশু বিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করছেন। ২০২০ সালে বিবিসির ১০০ নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন এই তরুণী কর্মী।
আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রিন নিউ ডিল এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করে চলেছেন। ২৯ বছর বয়সে কংগ্রেসে নির্বাচিত হয়ে তিনি আমেরিকান ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়সী নারী প্রতিনিধি হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। তার নেতৃত্বে তরুণ প্রজন্মের কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং সামাজিক সমতার দাবিতে আন্দোলন জোরদার হয়েছে।
ইরান ও আফগানিস্তানেও তরুণী নারীরা ‘ওম্যান, লাইফ, ফ্রিডম’ স্লোগানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মাহসা আমিনীর মৃত্যুর পর ইরানি নারীদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তাতে আফগান নারীরাও একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। তালেবানের নিপীড়নের বিরুদ্ধে আফগান নারীরা ইরানি বোনদের পাশে দাঁড়িয়ে একই সংগ্রামে একাত্মতার বার্তা দিয়েছেন।
সিরিয়ান সাঁতারু সারা মারদিনি শরণার্থী অধিকারের জন্য কাজ করছেন। তুরস্ক থেকে গ্রিসে পালানোর সময় নৌকা ডুবে যেতে থাকলে তিনি ও তার বোন ইউসরা সাঁতার কেটে নৌকা টেনে তীরে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে তিনি লেসবস দ্বীপে শরণার্থীদের সহায়তাকারী সংস্থায় অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন এবং নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্য শরণার্থীদের সাহস যুগিয়েছেন।
নাদিয়া মুরাদ ইয়েজিদি নারী হিসেবে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর নারী অধিকার ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য কাজ করে ২০১৮ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি থেকেও বৈশ্বিক পরিবর্তনের আন্দোলন শুরু হতে পারে।
আন্দোলনের ধরন বিবিধ হলেও এই তরুণীদের মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা প্রায় সকলেই তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। মালালার মতোই, এরা অল্প বয়স থেকেই নিজেদের আওয়াজ তুলে সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তারা তাদের বার্তা বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই তরুণী আন্দোলনকারীদের সফলতার পেছনে রয়েছে তাদের সততা, সাহস এবং কোনো প্রকার রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের উর্ধ্বে থেকে কাজ করার মানসিকতা। মালালার শিক্ষার জন্য সংগ্রাম থেকে শুরু করে গ্রেটার জলবায়ু আন্দোলন – প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা প্রমাণ করেছেন যে বয়স কোনো বাধা নয় যদি সাহস আর দৃঢ়তা থাকে।
প্রতিটি মহাদেশের এই তরুণীরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে এমন কিছু অবদান রেখেছেন যা আগামীর পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা প্রমাণ করেছেন যে পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই, বরং নিজেই সেই পরিবর্তনের কারিগর হওয়া সম্ভব। মালালা থেকে শুরু করে আজকের এই সব তরুণী নেত্রী – সবাই মিলে একটি নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছেন যেখানে ন্যায়বিচার, সমতা এবং মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।