Airtel AI fraud detection: ডিজিটাল যুগের সাথে সাথে অনলাইন জালিয়াতি ও সাইবার অপরাধের মাত্রা দিনকে দিন বাড়ছে। বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং ইমেইলের মাধ্যমে প্রতারণার ঘটনা ভয়াবহ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছে ভারতের অন্যতম শীর্ষ টেলিকম সংস্থা এয়ারটেল। সম্প্রতি (১৫ মে, ২০২৫) এয়ারটেল একটি অত্যাধুনিক এআই-চালিত জালিয়াতি শনাক্তকরণ সিস্টেম চালু করেছে, যা রিয়েল-টাইমে সমস্ত যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মে মেলিশিয়াস ওয়েবসাইট শনাক্ত ও ব্লক করতে সক্ষম।
এয়ারটেলের জালিয়াতি শনাক্তকরণ সিস্টেম: একটি বিশ্বের প্রথম উদ্যোগ
এয়ারটেলের নতুন এই সমাধান সমস্ত যোগাযোগ ওভার-দ্য-টপ (ওটিটি) অ্যাপস এবং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্ষতিকারক ওয়েবসাইটগুলি শনাক্ত ও ব্লক করবে। এর মধ্যে ইমেইল, ওয়েব ব্রাউজার, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এসএমএস এবং আরও অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই পরিষেবাটি এয়ারটেলের সমস্ত মোবাইল এবং ব্রডব্যান্ড গ্রাহকদের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় করা হবে, এবং তাদের কোনো অতিরিক্ত খরচ করতে হবে না।
গোপাল বিত্তাল, ভাইস চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ভারতী এয়ারটেল বলেন, “গত কয়েক বছরে আমরা অনেক ঘটনা দেখেছি যেখানে অবহেলা গ্রাহকরা চতুর অপরাধীদের দ্বারা তাদের কষ্টার্জিত অর্থ হারাচ্ছেন। আমাদের প্রকৌশলীরা আমাদের জালিয়াতি শনাক্তকরণ সমাধানের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি এটি আমাদের গ্রাহকদের ইন্টারনেট ব্রাউজিং করার সময় সম্পূর্ণ মনের শান্তি প্রদান করবে, প্রতারিত হওয়ার চিন্তা ছাড়াই।”
কীভাবে কাজ করে এয়ারটেলের জালিয়াতি শনাক্তকরণ সিস্টেম?
এয়ারটেলের এই নতুন সিস্টেমটি কীভাবে কাজ করে, তা জানা যাক বিস্তারিতভাবে:
রিয়েল-টাইম ইন্টারনেট ট্রাফিক মনিটরিং
যখনই আপনি ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে শুরু করেন, এয়ারটেলের এআই-চালিত সিস্টেম তৎক্ষণাৎ কাজে লেগে যায়। এটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যাওয়া সমস্ত ইন্টারনেট ট্র্যাফিক চুপিসারে স্ক্যান করে – ডেটা প্যাকেট, ওয়েব পেজ অনুরোধ এবং সার্ফিং ইতিহাস পড়ে। এই সবই রিয়েল টাইমে করা হয়, আপনার গতিতে কোন বাধা সৃষ্টি না করে।
স্মার্ট ডোমেইন ও URL পরীক্ষা
যখনই আপনি কোনো ওয়েবসাইট পরিদর্শন করতে বা কোনো লিঙ্কে ক্লিক করতে চান, সিস্টেমটি সঙ্গে সঙ্গে সেই URL বা ডোমেইনকে দুটি পরিশীলিত ডাটাবেসের বিপরীতে স্ক্যান করে:
- এয়ারটেলের অভ্যন্তরীণ জালিয়াতি শনাক্তকরণ লগ (লাখো ব্যবহারকারীর আচরণ থেকে সংকলিত)
- আন্তর্জাতিক থ্রেট ইন্টেলিজেন্স ফিড, যা নিয়মিতভাবে সাম্প্রতিকতম স্ক্যাম ডোমেইন এবং ফিশিং ওয়েবসাইটগুলির সাথে আপডেট করা হয়
এআই-ভিত্তিক থ্রেট বিশ্লেষণ
এবার আসে বুদ্ধিমান অংশ। এআই বিভিন্ন মাপদণ্ড মূল্যায়ন করে একটি সাইট বিপজ্জনক কিনা তা নির্ধারণ করে:
লিঙ্কের প্যাটার্ন এবং গঠন – এটি সন্দেহজনক বা একটি পরিচিত সাইটকে ছদ্মবেশ ধারণ করার চেষ্টা করছে কি?
আইপি খ্যাতি – যে সার্ভারে ওয়েবসাইটটি আছে সেটি কি অতীতে জালিয়াতির সাথে যুক্ত?
ব্যবহারকারীর আচরণ – কোন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে কি, যেমন সন্দেহজনক লিঙ্কে হঠাৎ বেশি ক্লিক?
বিসঙ্গতি – যেকোনো কিছু যা স্বাভাবিক দেখায় না এবং সন্দেহ জাগায় তা ফ্ল্যাগ করা হয়
তাৎক্ষণিক ব্লকিং এবং পুনঃনির্দেশনা
যদি AI ঝুঁকি সনাক্ত করে, তবে এটি তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করে। বিপজ্জনক সাইটের লিঙ্ক বন্ধ করা হয়, এবং পেজ লোড করার পরিবর্তে, আপনাকে একটি সতর্কতা বার্তা দেখানো হয়। বার্তাটি আপনাকে বলে যে কেন ওয়েবসাইটটি ব্লক করা হয়েছে, আপনাকে বিপদ সম্পর্কে অবহিত করে এবং ভবিষ্যতে আপনাকে সতর্ক রাখে।
ক্রমাগত শেখা এবং বিকশিত হওয়া
কেকের উপর আইসিং? সিস্টেমটি নিরন্তর শিখছে। প্রতিবারই যখন জালিয়াতির নতুন প্রচেষ্টা দেখা যায়, এআই আরও শেখে। মেশিন লার্নিংয়ের কারণে, এটি উদীয়মান নতুন হুমকি থেকে দ্রুত শেখে, এবং সিস্টেমটি দিন দিন আরও দক্ষ ও সঠিক হয়ে ওঠে।
সমস্ত প্ল্যাটফর্মে সুরক্ষা প্রদান করে এয়ারটেলের সিস্টেম
এয়ারটেলের এই সিস্টেমটি যে বিষয়টি একে অন্যান্য সিকিউরিটি সলিউশন থেকে আলাদা করে তা হল এর সুরক্ষার ব্যাপকতা। অন্যান্য সুরক্ষা সমাধানগুলি টেক্সট মেসেজ বা ইমেল স্ক্যান করে, কিন্তু এয়ারটেলের সিস্টেম আরও অনেক কিছু করে। এটি জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম যেমন:
- নেটফ্লিক্স, হটস্টার এবং অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও
- জিমেইল বা ইয়াহু মেইলের মতো ইমেলগুলি
- ক্রোম, ফায়ারফক্স বা সাফারিতে আপনার সমস্ত ব্রাউজিং
- ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং টুইটার/এক্স এর মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট
- হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম এবং সিগনালের মতো মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম
- এসএমএস মেসেজ
মূলত, যোগাযোগের সকল চ্যানেলে আপনি সুরক্ষিত থাকবেন।
অনলাইন জালিয়াতির বিরুদ্ধে এয়ারটেলের পদক্ষেপের গুরুত্ব
অনলাইন জালিয়াতি ভারতে এবং বিশ্বব্যাপী একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান হারে ছড়িয়ে পড়ার ফলে এবং ভোক্তাদের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করার ফলে অনলাইন জালিয়াতির হুমকি প্রতিদিন বাড়ছে। সাম্প্রতিক দিনগুলিতে এই ধরনের হুমকিগুলিতে উদ্বেগজনক বৃদ্ধি হয়েছে।
জালিয়াতির কৌশলগুলি এখন কেবল ওটিপি জালিয়াতি এবং প্রতারণামূলক কলের চেয়েও অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, লাখো লাখো ব্যক্তি বিভিন্ন মেলিশিয়াস অনলাইন স্ক্যামের শিকার হয়েছেন। এই পরিস্থিতির গুরুত্ব স্বীকার করে, এয়ারটেল একটি এআই-চালিত, মাল্টি-টায়ার্ড ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফর্ম বাস্তবায়ন করেছে যা গ্রাহকদের সম্পূর্ণ স্ক্যাম এবং জালিয়াতি থেকে রক্ষা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য: আইএমইআই ট্র্যাকিং
এয়ারটেলের এআই সিস্টেম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করে: জালিয়াতিমূলক কল। অনেক প্রতারক শনাক্তকরণ এড়াতে আইএমইআই নম্বর (মোবাইল ডিভাইসের জন্য অনন্য শনাক্তকারী) পরিবর্তনের মতো কৌশল ব্যবহার করে। এয়ারটেলের নতুন সিস্টেম আইএমইআই পরিবর্তনের মধ্যে অস্বাভাবিকতা সনাক্ত করতে পারে, যা প্রায়শই জালিয়াতিমূলক কার্যকলাপের একটি লাল পতাকা।
সরকারী কর্তৃপক্ষ, ডেলিভারি পরিষেবা এবং ক্রেডিট প্রদানকারীদের অনুকরণ করে প্রতারকদের বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে, এই বৈশিষ্ট্যটি জালিয়াতি মোকাবেলায় এবং ব্যবহারকারীদের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এয়ারটেলের সিস্টেমের দক্ষতা এবং প্রভাব
এয়ারটেলের এআই-চালিত সিস্টেমটি প্রতিদিন অবিশ্বাস্য পরিমাণ ডেটা প্রসেস করে। এটি প্রতিদিন ১.৫ বিলিয়ন বার্তা এবং ২.৫ বিলিয়ন কল প্রক্রিয়া করতে সক্ষম। এই অ্যালগরিদম বিভিন্ন প্যারামিটার বিশ্লেষণ করে এবং রিয়েল-টাইমে এই প্যাটার্ন অধ্যয়ন করে, সিস্টেমটি প্রতিদিন ১০০ মিলিয়ন সম্ভাব্য স্প্যাম কল এবং ৩ মিলিয়ন স্প্যাম বার্তা শনাক্ত করে ব্লক করতে পারে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এআই সিস্টেমটি মেলিশিয়াস লিঙ্কের জন্য এসএমএস বিষয়বস্তুও স্ক্যান করে। ফিশিং এবং জালিয়াতি ক্রমশ সাধারণ হয়ে ওঠার সাথে সাথে, অনেক স্ক্যাম একটি সহজ এসএমএস লিঙ্ক দিয়ে শুরু হয়। এয়ারটেলের সিস্টেম লিঙ্কগুলিকে ব্ল্যাকলিস্টেড URL-এর একটি কেন্দ্রীভূত ডাটাবেসের সাথে ক্রস-রেফারেন্স করে, ব্যবহারকারীদের সম্ভাব্য জালিয়াতি এবং ফিশিং আক্রমণ থেকে রক্षা করে।
জাতীয় স্তরে রোলআউট পরিকল্পনা
বর্তমানে, এই পরিষেবা হরিয়ানা সার্কেলে উপলব্ধ, এবং অতি সত্বর সারা দেশে রোলআউট করার পরিকল্পনা রয়েছে। এয়ারটেলের নেটওয়ার্কে ৩৮ কোটিরও বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে, যারা এই নতুন সুরক্ষা ব্যবস্থা থেকে উপকৃত হবে।
এয়ারটেলের জালিয়াতি শনাক্তকরণ সমাধান: একটি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষামূলক পদ্ধতি
যদি আপনি দুর্ঘটনাক্রমে একটি ঝুঁকিপূর্ণ সাইটে ক্লিক করেন, এয়ারটেলের সিস্টেম নীরবে এটি ব্লক করে না। বরং, এটি পেজ লোড হওয়া থেকে বাধা দেয় এবং আপনাকে একটি তথ্যপূর্ণ পৃষ্ঠায় নিয়ে যায়। এই পৃষ্ঠায় বলা হয় কেন সাইটটি ব্লক করা হয়েছে এবং সম্ভাব্য বিপদগুলি কী।
এই চিন্তাশীল পদ্ধতি বিশেষভাবে সেইসব ব্যবহারকারীদের জন্য সহায়ক যারা খুব বেশি টেক-স্মার্ট নন, যেমন বয়স্ক ব্যবহারকারীরা বা ছোট বাচ্চারা যারা হয়তো জানে না আজকের ইন্টারনেট জালিয়াতি কতটা সুক্ষ্ম ও পরিশীলিত। এটি একইসাথে শিক্ষিত এবং সুরক্ষিত থাকার একটি সহজ কিন্তু কার্যকর উপায়।
এয়ারটেলের প্রতিশ্রুতি: নিরাপদ ডিজিটাল অভিজ্ঞতা
এই এআই-চালিত সুরক্ষা আপগ্রেডের মাধ্যমে, এয়ারটেল প্রত্যেক ভারতীয় ব্যবহারকারীর জন্য একটি আরও নিরাপদ এবং সুরক্ষিত ডিজিটাল অভিজ্ঞতা সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেছে। কোম্পানি বলেছে যে তারা ক্রমাগত কাজ করে যাবে, যতক্ষণ না তাদের নেটওয়ার্ক স্প্যাম এবং স্ক্যাম থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়।
গোপাল বিত্তাল আরও বলেন, “আমাদের এআই ভিত্তিক টুল ইন্টারনেট ট্র্যাফিক স্ক্যান করে, গ্লোবাল রেপোজিটরি এবং আমাদের নিজস্ব থ্রেট অ্যাক্টর ডাটাবেস চেক করে এবং রিয়েল-টাইমে জালিয়াতিমূলক ওয়েবসাইট ব্লক করে। আমাদের সমাধান ইতিমধ্যেই ৬ মাসের ট্রায়ালে উল্লেখযোগ্য মাত্রার সঠিকতা অর্জন করেছে। আমরা নিরলসভাবে কাজ করতে থাকব যতক্ষণ না আমরা আমাদের নেটওয়ার্ক স্প্যাম এবং স্ক্যাম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করি।”
ডিজিটাল যুগে, বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং ইমেলের মতো প্ল্যাটফর্মে অনলাইন নিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। এয়ারটেলের নতুন এআই-চালিত জালিয়াতি শনাক্তকরণ সমাধান এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি বড় ধাপ। এটি ভারতে ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবং দেখায় যে কীভাবে এআই প্রযুক্তি আমাদের সবার জন্য অনলাইন জগতকে আরও নিরাপদ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এয়ারটেলের জালিয়াতি শনাক্তকরণ সিস্টেম ভবিষ্যতে আরও উন্নত হওয়ার সাথে সাথে, আমরা আশা করতে পারি যে এটি ডিজিটাল জালিয়াতি ও প্রতারণা মোকাবেলায় আরও কার্যকর হবে, যা শেষ পর্যন্ত ভারতের ডিজিটাল পরিবেশকে সকলের জন্য আরও নিরাপদ করে তুলবে। এয়ারটেলের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক যা আগামী দিনগুলিতে অন্যান্য টেলিকম এবং ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীদের অনুসরণ করতে উৎসাহিত করবে।
