নির্মাতাদের না জানিয়েই Shorts এডিট করছে AI? বিতর্কের ঝড়ে মুখ খুলল YouTube, জানাল ‘পরীক্ষা চলছে’

সম্প্রতি ইউটিউব শর্টস (YouTube Shorts) নির্মাতাদের মধ্যে এক নতুন উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। একাধিক জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর অভিযোগ করেছেন যে, তাদের আপলোড করা ভিডিওতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI ব্যবহার করে বিভিন্ন…

Soumya Chatterjee

 

সম্প্রতি ইউটিউব শর্টস (YouTube Shorts) নির্মাতাদের মধ্যে এক নতুন উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। একাধিক জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর অভিযোগ করেছেন যে, তাদের আপলোড করা ভিডিওতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI ব্যবহার করে বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হচ্ছে, যা তাদের অনুমতি ছাড়াই ঘটছে। এই ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে অবশেষে ইউটিউব কর্তৃপক্ষ মুখ খুলেছে। তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এটি একটি নতুন ফিচারের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ, যা কনটেন্ট নির্মাতাদের সাহায্য করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। তবে এই জবাবে বিতর্কের অবসান হয়নি, বরং প্রযুক্তি ও সৃজনশীলতার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।

ঘটনার সূত্রপাত হয় যখন বেশ কিছু ইউটিউবার লক্ষ্য করেন যে, তাদের শর্টস ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ডে এমন কিছু দৃশ্য বা গ্রাফিক্স যুক্ত হচ্ছে যা তারা নিজেরা যোগ করেননি। প্রাথমিকভাবে অনেকেই ভেবেছিলেন এটি কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা হ্যাকিংয়ের ঘটনা। কিন্তু যখন একাধিক ক্রিয়েটর একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান, তখন বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে এর পেছনে ইউটিউবের নিজস্ব কোনো সিস্টেম কাজ করছে। মূলত, “Dream Screen” নামে একটি নতুন জেনারেটিভ AI ফিচারের পরীক্ষা চালাচ্ছে ইউটিউব। এই ফিচারের মাধ্যমে নির্মাতারা শুধুমাত্র একটি টেক্সট প্রম্পট (লিখিত নির্দেশ) ব্যবহার করে তাদের ভিডিওর জন্য আকর্ষণীয় এবং কাল্পনিক ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করতে পারবেন। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছে এই ফিচারটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পদ্ধতি নিয়ে।

কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের মূল অভিযোগ হলো, এই পরিবর্তন সম্পর্কে তাদের আগে থেকে কোনো স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়নি। তাদের মতে, কোনো ধরনের সম্মতি না নিয়েই তাদের ভিডিওতে এই AI টুল ব্যবহার করা হয়েছে, যা তাদের সৃজনশীল স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের সামিল। একজন ক্রিয়েটর টুইটারে (বর্তমান X) জানান, “আমি আমার ভিডিওর একটি নির্দিষ্ট থিম ও বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ইউটিউবের AI যদি নিজের ইচ্ছামতো ব্যাকগ্রাউন্ড বদলে দেয়, তবে আমার মূল ভাবনাটিই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।” এই ধরনের মন্তব্যের পর থেকেই প্রযুক্তি জগতে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অনেকেই একে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য ও সৃজনশীলতার অধিকারে হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন।

বিতর্ক বাড়তে থাকায় ইউটিউবের মুখপাত্র জেক বেটস একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রদান করেন। তিনি জানান, “আমরা সবসময় নতুন কিছু করার চেষ্টা করি, যা আমাদের ক্রিয়েটরদের নতুন আঙ্গিকে গল্প বলতে সাহায্য করবে। ‘Dream Screen’ তেমনই একটি পরীক্ষামূলক ফিচার।” তিনি আরও বলেন যে, বর্তমানে খুব অল্প সংখ্যক ইংরেজিভাষী ক্রিয়েটরের উপর এই পরীক্ষাটি চালানো হচ্ছে এবং তাদের মতামত সংগ্রহ করে ফিচারটিকে আরও উন্নত করা হবে। ইউটিউবের লক্ষ্য হলো, এর মাধ্যমে যেন নির্মাতারা আরও সহজে এবং কম সময়ে আকর্ষণীয় ভিডিও তৈরি করতে পারেন। তবে সম্মতি না নেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে তারা জানিয়েছে যে, এই পরীক্ষাটিতে অংশ নেওয়া ক্রিয়েটরদের কাছে একটি পপ-আপ নোটিফিকেশন পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু অনেকেই হয়তো সেই নোটিফিকেশনটি না দেখেই এড়িয়ে গেছেন, যা থেকে এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

এই ঘটনাটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এবং এর নৈতিকতা নিয়ে পুরোনো বিতর্ককে নতুন করে উস্কে দিয়েছে। একদিকে যেমন AI প্রযুক্তি কনটেন্ট তৈরিকে অনেক সহজ করে দিচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে এটি সৃজনশীল মানুষের কাজ কেড়ে নিতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। অতীতেও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে AI ব্যবহারের ফলে এমন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যেমন, ছবি আঁকার AI টুল ‘Midjourney’ বা ‘DALL-E’ বাজারে আসার পর চিত্রশিল্পীদের মধ্যে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ দেখা গিয়েছিল। একইভাবে, OpenAI-এর ‘Sora’-র মতো টেক্সট-টু-ভিডিও জেনারেটর আসায় ভিডিও এডিটর এবং অ্যানিমেটরদের মধ্যেও কর্মহীনতার ভয় তৈরি হয়েছে। ইউটিউবের এই নতুন পদক্ষেপ সেই আলোচনাকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে নতুন ফিচার আনার আগে ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আরও স্বচ্ছভাবে संवाद স্থাপন করতে হবে। বিশেষ করে যখন কোনো টুল ব্যবহারকারীর তৈরি করা কনটেন্টে সরাসরি পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রাখে, তখন তাদের সম্মতি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই ধরনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে ‘Opt-in’ বা ‘Opt-out’ (অংশ নেওয়ার বা না নেওয়ার) সুবিধা দেওয়া উচিত। যদি ব্যবহারকারীরা স্ব-ইচ্ছায় নতুন ফিচার ব্যবহার করে মতামত দেন, তবে এ ধরনের বিতর্ক এড়ানো সম্ভব। ইউটিউবের এই ঘটনাটি অন্যান্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর জন্যও একটি বড় শিক্ষা হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, ইউটিউবের AI দ্বারা শর্টস সম্পাদনার এই ঘটনাটি প্রযুক্তি এবং সৃজনশীলতার মধ্যে এক সূক্ষ্ম লড়াইয়ের প্রতিফলন। ইউটিউব হয়তো ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই এই পরীক্ষা শুরু করেছিল, কিন্তু স্বচ্ছতার অভাবে তা নির্মাতাদের মধ্যে উদ্বেগ ও недоверие তৈরি করেছে। এই বিতর্কের ফলে ভবিষ্যতে ইউটিউব বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ স্থাপন করবে, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে এটা স্পষ্ট যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের ডিজিটাল জীবনে আরও গভীর প্রভাব ফেলতে চলেছে এবং এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি সংস্থা ও ব্যবহারকারী উভয়কেই সচেতন থাকতে হবে। ইউটিউবের এই AI সম্পাদনার পরীক্ষা সেই ভবিষ্যতেরই একটি পূর্বাভাস মাত্র।

About Author
Soumya Chatterjee

সৌম্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক এবং প্রযুক্তি বিষয়ক লেখালিখিতে বিশেষ আগ্রহী। তিনি একজন উদ্যমী লেখক, যিনি প্রযুক্তির জটিল ধারণাগুলোকে সহজভাবে উপস্থাপন করতে দক্ষ। তার লেখার মূল ক্ষেত্রগুলোতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নতুন প্রযুক্তি, গ্যাজেট রিভিউ, সফটওয়্যার গাইড, এবং উদীয়মান টেক প্রবণতা। সৌম্যর প্রাঞ্জল ও তথ্যবহুল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। প্রযুক্তি সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান এবং অনুসন্ধিৎসু মনোভাব তাকে পাঠকদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছে। টেক জগতে চলমান পরিবর্তনগুলির সাথে তাল মিলিয়ে সৌম্য সর্বদা নতুন ও তথ্যসমৃদ্ধ বিষয়বস্তু নিয়ে আসতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।