বাংলাদেশে আগামী বছরের শুরুতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে আশ্বাস দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। একই সাথে ফেব্রুয়ারি মাসকে লক্ষ্য রেখে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সোমবার সন্ধ্যায় দুই নেতার মধ্যে অনুষ্ঠিত টেলিফোন আলাপে গণতান্ত্রিক উত্তরণের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময় সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টার মধ্যে প্রায় ১৫ মিনিটব্যাপী এই ফোনালাপ ছিল উষ্ণ, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও গঠনমূলক। আলোচনায় উভয় নেতা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন, যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আলোচনা, চলমান সংস্কারপ্রক্রিয়া এবং আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের বিষয়াদি।
গণতান্ত্রিক উত্তরণে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কামনা করে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন যে, আগামী বছরের শুরুতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান সংলাপ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত সংস্কারে সহায়ক হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও বাংলাদেশের সংস্কার কর্মসূচি এবং আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগকে সমর্থন জানান।
নির্বাচন কমিশনের কাজের প্রসঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস উল্লেখ করেন যে, নির্বাচন কমিশন নিরলস পরিশ্রম করছে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে, যা পূর্ববর্তী সরকার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছিল। তিনি আরও জানান, দেশের তরুণেরা এবার জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দেবে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের অভিযো
এদিকে, ফেব্রুয়ারি মাসকে চিন্তায় রেখে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন দেখতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার, এজন্য নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।
সার্বিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে পুলিশ ইতিমধ্যে সারা দেশে ৪৭ হাজার ভোট কেন্দ্রকে ধারণায় রেখে প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা নিয়েছে3। অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে পুলিশে শিগগিরই শুরু হবে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। এজন্য নতুন প্রশিক্ষণ কারিকুলাম ও ডকুমেন্টারির কাজ শুরু করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় প্রথমে পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেবে পুলিশ সদর দপ্তর। তারা আবার নিজ নিজ জেলা ও মহানগর পুলিশের মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনবেন। বিতর্কমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে প্রশিক্ষণ পরিকল্পনায় মক টেস্টের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামগ্রিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্বাচনের আগে সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে অন্তত দুটি মহড়া দিতে বলেছে। একটি মহড়া হবে সেপ্টেম্বরে, অন্যটি নির্বাচনের ঠিক আগে। সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত একজন উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচনে সহিংসতা হবে, এটা ধরে নিয়েই প্রস্তুতি নিতে হবে। সরকারের যেসব সংস্থা নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাদের সবার সমন্বয়ে দুটি মহড়া দিতে হবে, যাতে সহিংসতা কমানো বা এড়ানো যায়।
বিগত নির্বাচনগুলোর বিতর্কিত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার পুলিশ বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছে। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, বিশেষ করে ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে করার ঘটনায় পুলিশকে সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছে3। এমন প্রশ্নবিদ্ধ কোনো কাজে পুলিশ যেন না জড়ায়, সে বিষয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন।
নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের নাম বদলে সিটিজেন পুলিশিং দিয়ে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে আগ্রহী করার কর্মসূচি নেওয়ার বিষয়টিও পরিকল্পনায় রেখেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এর পেছনে রয়েছে বিগত তিনটি নির্বাচনে অধিকাংশ ভোটার ভোট দিতে আগ্রহী না থাকার অভিজ্ঞতা।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে রুবিও-ইউনূস আলোচনায় অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য এবং রেমিট্যান্সের শীর্ষ উৎস। এর পরিপ্রেক্ষিতে উভয় নেতা শিগগিরই শুল্ক বিষয়ে আলোচনা চূড়ান্ত হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে অভিন্ন অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন দুই নেতা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ধারাবাহিক উদার সহায়তা প্রদান করায় ওয়াশিংটনের প্রশংসা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
সামগ্রিকভাবে, নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার এই সমন্বিত উদ্যোগ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে আরও মসৃণ করার দিকে ইঙ্গিত করছে। আগামী বছরের শুরুতে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশ পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রত্যাশায় রয়েছে।