ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী ওস্তাদ জাকির হুসেন আর নেই। ৭৩ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সারা বিশ্বের সঙ্গীত জগতে। তবলার জাদুকর হিসেবে পরিচিত এই শিল্পী শুধু ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন ধারার সঙ্গীতকে একসূত্রে গেঁথে এক অনন্য সৃষ্টি করেছিলেন।
ওস্তাদ জাকির হুসেনর জীবনের শুরুর দিক
১৯৫১ সালের ৯ মার্চ মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন জাকির হুসেন। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত তবলা শিল্পী ওস্তাদ আল্লা রাখা। ছোটবেলা থেকেই পিতার কাছে তবলা শিক্ষা শুরু করেন জাকির। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি প্রথম পাবলিক পারফরম্যান্স দেন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।
অসামান্য ক্যারিয়ার
জাকির হুসেনের ক্যারিয়ার ছিল বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ। তিনি শুধু ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর সহযোগিতা ছিল অবিস্মরণীয়। জন ম্যাকলফলিন, যো-যো মা, বেলা ফ্লেক, এডগার মেয়ার, মিকি হার্ট, জর্জ হ্যারিসনের মতো শিল্পীদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন।
সরোদ সম্রাট Aashish Khan-এর মৃত্যুতে শোকের ছায়া: বিশ্ব হারালো এক কিংবদন্তিকে
পুরস্কার ও সম্মাননা
জাকির হুসেনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে নানা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে:
– পদ্মশ্রী (১৯৮৮)
– পদ্মভূষণ (২০০২)
– পদ্মবিভূষণ (২০২৩)
– সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার (১৯৯০)
– ন্যাশনাল হেরিটেজ ফেলোশিপ (১৯৯৯)
– গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড (মোট ৫টি)
বিশ্ব সঙ্গীতে ওস্তাদ জাকির হুসেনর অবদান
জাকির হুসেন শুধু তবলা বাদক হিসেবেই নয়, একজন সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবেও বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত রচনা করেছেন। তাঁর রচিত ‘ভানপ্রস্থম’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীত ১৯৯৯ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল।
শিক্ষক হিসেবে অবদান
জাকির হুসেন শুধু একজন শিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী শিক্ষকও। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল অনন্য, যা নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করেছে।
সাংস্কৃতিক দূত
জাকির হুসেন ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গীত ছিল সংস্কৃতির সেতুবন্ধন, যা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সেতু রচনা করেছে।
মস্তিষ্কের মহাকাব্য: আপনার সন্তানের প্রতিভা বিকাশের ১০টি অমোঘ কৌশল
শেষ দিনগুলি
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জাকির হুসেন সঙ্গীত চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি তিনটি গ্র্যামি পুরস্কার জয় করেন, যা তাঁর অসামান্য প্রতিভার স্বীকৃতি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এর কয়েক মাস পরেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।
শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
জাকির হুসেনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গীত শিল্পীরা। প্রাক্তন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিল্পীর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
উত্তরসূরি
জাকির হুসেন তাঁর পিছনে রেখে গেছেন এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। তাঁর শিষ্যরা এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন, যারা তাঁর শিক্ষা ও দর্শনকে বহন করে চলেছেন। তাঁর সৃষ্ট সঙ্গীত আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে থাকবে।
শেষ কথা
জাকির হুসেনের মৃত্যু শুধু ভারতীয় সঙ্গীত জগতের ক্ষতি নয়, এটি বিশ্ব সঙ্গীতের এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর সৃষ্ট সঙ্গীত, তাঁর দর্শন, তাঁর শিক্ষা চিরকাল মানুষের মনে জীবন্ত থাকবে। তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে সঙ্গীত কোনো সীমানা মানে না, এটি সকল মানুষের, সকল সংস্কৃতির।
ওস্তাদ জাকির হুসেনের প্রয়াণে আমরা হারালাম এক মহান শিল্পীকে, কিন্তু তাঁর সৃষ্ট সঙ্গীত চিরকাল আমাদের সঙ্গে থাকবে, আমাদের অনুপ্রাণিত করবে। তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে আমরা শিখব কীভাবে নিজের শিকড়কে ধরে রেখে বিশ্বের সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি হবে তাঁর সৃষ্ট সঙ্গীতকে জীবন্ত রাখা, তা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া।