সিঙ্গাপুরে স্কুবা ডাইভিংয়ের দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু অসমের হৃদয় জুবিন গর্গের – সংগীত জগতে নেমে এল অকল্পনীয় শোকের ছায়া

বিশ্ববিখ্যাত অসমিয়া গায়ক ও সংগীত পরিচালক জুবিন গর্গ শুক্রবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সিঙ্গাপুরে স্কুবা ডাইভিংয়ের মারাত্মক দুর্ঘটনায় ৫২ বছর বয়সে অকাল মৃত্যুবরণ করেছেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশ নিতে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন…

Sangita Chowdhury

 

বিশ্ববিখ্যাত অসমিয়া গায়ক ও সংগীত পরিচালক জুবিন গর্গ শুক্রবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সিঙ্গাপুরে স্কুবা ডাইভিংয়ের মারাত্মক দুর্ঘটনায় ৫২ বছর বয়সে অকাল মৃত্যুবরণ করেছেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশ নিতে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন তিনি। সিঙ্গাপুরের পুলিশ সমুদ্র থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করলেও চিকিৎসকদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।

মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত জুবিন সিঙ্গাপুরে উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর সান্টেক সিঙ্গাপুর কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত উত্তর-পূর্ব ভারত উৎসবে তিনি মূল পারফরমার ছিলেন। উৎসবের শেষ দিন তার একটি অবিস্মরণীয় পরিবেশনার কথা ছিল, যা আর হয়ে উঠল না। পরিবর্তে এসে গেল এক অবর্ণনীয় বিয়োগান্তক সংবাদ যা পুরো উত্তর-পূর্ব ভারত এবং দেশের সংগীতপ্রেমীদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে।

অসমের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী অশোক সিংহাল সামাজিক মাধ্যমে জুবিন গর্গের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন, “আমাদের প্রিয় জুবিন গর্গের অকাল মৃত্যুতে গভীরভাবে মর্মাহত। অসম কেবল একটি কণ্ঠস্বর হারায়নি, হারিয়েছে তার হৃদস্পন্দন”। তিনি আরও লিখেছেন, “জুবিন দা ছিলেন একজন গায়কের চেয়েও বেশি কিছু, তিনি ছিলেন অসম ও দেশের গর্ব, যার গান আমাদের সংস্কৃতি, আবেগ ও আত্মাকে বিশ্বের প্রতিটি কোণে পৌঁছে দিয়েছে”।

জুবিন গর্গের জীবন ছিল সংগীতের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। ১৯৭২ সালের ১৮ নভেম্বর মেঘালয়ের তুরায় জন্মগ্রহণকারী জীবন বরঠাকুর নামের এই শিল্পী প্রসিদ্ধ সংগীত পরিচালক জুবিন মেহতার নাম অনুসারে ‘জুবিন গর্গ’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তার বাবা মহিনী বরঠাকুর (ছদ্মনাম কপিল ঠাকুর) ছিলেন একজন গীতিকার ও কবি, আর মা ইলি বরঠাকুর ছিলেন একজন নৃত্যশিল্পী, অভিনেত্রী ও গায়িকা। পারিবারিক পরিবেশেই সংগীতের প্রতি তার ভালোবাসা জন্মেছিল।

১৯৯২ সালে গায়ক হিসেবে জুবিনের যাত্রা শুরু হলেও সত্যিকারের খ্যাতি এসেছিল ২০০৬ সালে বলিউড ছবি ‘গ্যাংস্টার’-এর “ইয়া আলি” গানের মাধ্যমে। প্রীতম দাসের সুর করা এই গানটি তাকে রাতারাতি জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত করে তোলে। এর আগে তিনি ‘ফিজা’ ছবিতে “মের ওয়াতান” এবং ‘কাান্তে’ ছবিতে “জানে ক্যা হোগা রামা রে” গানও গেয়েছিলেন।

সংগীত পরিচালনাতেও জুবিনের অবদান অনস্বীকার্য। ২৬টি অসমিয়া ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি। ‘হিয়া দিয়া নিয়া’, ‘দাগ’, ‘নায়ক’, ‘প্রেম আরু প্রেম’-এর মতো অসংখ্য ছবিতে তার সংগীত অসমিয়া চলচ্চিত্রকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। শুধু গায়ক বা সংগীত পরিচালক নন, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতাও। ‘মিশন চায়না’ (২০১৭) এবং ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ (২০১৯) ছবি পরিচালনা করেছেন তিনি।

জুবিন গর্গ ৪০টি ভিন্ন ভাষা ও উপভাষায় গান গেয়েছেন – যা উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রে ঘটেছে। তার গাওয়া গানের সংখ্যা ৩২,০০০-এরও বেশি এবং ১২টি ভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন তিনি। অসমিয়া, বাংলা, হিন্দি ছাড়াও তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালয়ালম, মারাঠি, ওড়িয়া, বোড়ো, নেপালি ভাষায় গান গেয়েছেন।

২০০৯ সালে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন ‘ইকোজ অব সাইলেন্স’ নামের নন-ফিচার ফিল্মে সেরা সংগীত পরিচালনার জন্য। ২০০৬ সালে “ইয়া আলি” গানের জন্য গ্লোবাল ইন্ডিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে সেরা পুরুষ প্লেব্যাক সিঙ্গারের পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০০৭ সালে স্টারডাস্ট অ্যাওয়ার্ডেও সম্মানিত হয়েছিলেন। তার আরও উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘মায়াবিনী’, ‘মন যাই’, ‘কার পরখ’, ‘দিয়া ঘুরাই দিয়া’, ‘পাখি পাখি এই মন’।

ব্যক্তিগত জীবনে জুবিন বিবাহিত ছিলেন ফ্যাশন ডিজাইনার গরিমা শইকিয়া গর্গের সাথে। তাদের শুভী গর্গ নামে একটি কন্যা রয়েছে। ২০০২ সালে তার ছোট বোন জঙ্কী বরঠাকুর গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান, যা জুবিনের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। জঙ্কীও একজন প্রতিশ্রুতিশীল গায়িকা ছিলেন।

শিল্পী হিসেবে জুবিন শুধু বিনোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতায়ও তিনি ছিলেন সোচ্চার। ২০১৯ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) বিরোধিতায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। গুয়াহাটিতে চন্দ্রমারীর আসাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের মাঠে বিক্ষোভের সময় তার আবেগময় পরিবেশনা হাজারো মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। সেই আন্দোলনে নিহত পাঁচজনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি গেয়েছিলেন তার বিখ্যাত গানের একটি লাইন: “জীবন দিয়ার ক্ষমতা নু কার? জীবন লুয়ার ক্ষমতা অপার”।

সাম্প্রতিক সময়ে জুবিনের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ ছিল। ২০২৫ সালের মে মাসে গুয়াহাটিতে ‘ভাইমন দা’ ছবির প্রিমিয়ারে বুকে ব্যথা ও বমি বমিভাবের কারণে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। কিন্তু সেবার সুস্থ হয়ে ওঠার পর তিনি আবার সংগীতে মনোনিবেশ করেছিলেন।

জুবিন গর্গের মৃত্যুতে শুধু অসম নয়, পুরো উত্তর-পূর্ব ভারত এবং দেশের সংগীতাঙ্গন শোকের ছায়ায় ঢেকে গেছে। সামাজিক মাধ্যমে ভক্ত, সহশিল্পী ও রাজনীতিবিদরা তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। অসমিয়া সংগীত জগতে তিনি ছিলেন একটি আইকন, যার গলার স্বরে পুরো প্রজন্ম বড় হয়েছে।

সিঙ্গাপুরে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রদূত হিসেবে গিয়েছিলেন জুবিন। সেখানে তিনি অসমিয়া, হিন্দি ও বাংলা গান পরিবেশনার কথা ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্নই অধরা থেকে গেল। তার সর্বশেষ পরিবেশনা ছিল এরিক ক্ল্যাপটনের বিখ্যাত “টিয়ার্স ইন হেভেন” গানটি, যা তিনি সিঙ্গাপুরের রাস্তায় দর্শকদের সামনে গেয়েছিলেন।

জুবিন গর্গের মৃত্যু কেবল একজন শিল্পীর প্রয়াণ নয়, এটি একটি যুগের অবসান। তিনি অসমিয়া সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, লোকসংগীত থেকে শুরু করে আধুনিক সংগীতে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার কণ্ঠে “মায়াবিনী”, “মন যাই”, “দিয়া ঘুরাই দিয়া”-এর মতো গানগুলো আজও কোটি মানুষের হৃদয়ে বাজে।

সংগীত জগতের এই মহান ক্ষতির সাথে মানিয়ে নেওয়া সহজ হবে না। জুবিন গর্গ চলে গেলেও তার সৃষ্টি, তার গান, তার অবদান চিরকাল বেঁচে থাকবে লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে। অসমের হৃদয়, উত্তর-পূর্বের অহংকার জুবিন গর্গের বিদায়ে আজ একটি যুগের সমাপ্তি ঘটল।

About Author