জুবিনের শেষকৃত্যে জনজোয়ার, লিমকা রেকর্ডের দাবিতে আলোড়ন: বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম জনসমাগম?

 আসামের সাংস্কৃতিক আইকন, কিংবদন্তী শিল্পী জুবিন গর্গের শেষযাত্রায় গুয়াহাটির রাজপথে নামল জনসমুদ্র। শুক্রবার সিঙ্গাপুরে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তাঁর অকাল প্রয়াণের পর, রবি ও সোমবার শিল্পীর মরদেহকে কেন্দ্র করে যে আবেগ…

Srijita Ghosh

 

 আসামের সাংস্কৃতিক আইকন, কিংবদন্তী শিল্পী জুবিন গর্গের শেষযাত্রায় গুয়াহাটির রাজপথে নামল জনসমুদ্র। শুক্রবার সিঙ্গাপুরে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তাঁর অকাল প্রয়াণের পর, রবি ও সোমবার শিল্পীর মরদেহকে কেন্দ্র করে যে আবেগ ও জনসমাগম দেখা গেছে, তা আসামের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এর মধ্যেই কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, লিমকা বুক অফ রেকর্ডস এই জনসমাবেশকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাবেশ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। (Zubeen Garg)

শিল্পীর মরদেহ গুয়াহাটিতে পৌঁছানোর পর থেকে শুরু করে अंतिम संस्कार পর্যন্ত, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা যেন পরিণত হয়েছিল এক শোকমিছিলে। অনুরাগী, সহকর্মী এবং সাধারণ মানুষের কান্না আর জুবিনের গানে ভারী হয়ে উঠেছিল শহরের বাতাস। যদিও এই জমায়েতের আকার নিয়ে সরকারিভাবে কোনো চূড়ান্ত সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি, তবে এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (Key Facts):

  • অকাল প্রয়াণ: ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, শুক্রবার, সিঙ্গাপুরে একটি সাঁতার দুর্ঘটনার সময় ৫২ বছর বয়সে জনপ্রিয় শিল্পী জুবিন গর্গের মৃত্যু হয়।
  • শেষযাত্রা: ২১-২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, তাঁর মরদেহ গুয়াহাটিতে আনা হয় এবং সারুসজাই স্টেডিয়ামে জনসাধারণের শ্রদ্ধার জন্য রাখা হয়। এখানেই লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।
  • রেকর্ডের দাবি: উত্তর-পূর্ব ভারতের একাধিক সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে যে লিমকা বুক অফ রেকর্ডস এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জনসমাগমকে বিশ্বের ইতিহাসে চতুর্থ বৃহত্তম হিসাবে নথিভুক্ত করেছে। যদিও লিমকা বুক অফ রেকর্ডসের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি এখনও পর্যন্ত (২২ সেপ্টেম্বর বিকেল পর্যন্ত) প্রকাশ করা হয়নি।
  • সরকারি প্রতিক্রিয়া: আসাম সরকার রাজ্যে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে এবং পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শিল্পীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ব্যক্তিগতভাবে পুরো প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান করছেন।

 সিঙ্গাপুর থেকে গুয়াহাটি

উত্তর-পূর্ব ভারত উৎসব (North East India Festival)-এ অংশ নিতে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন জুবিন গর্গ। উৎসবের আয়োজকদের বয়ান অনুযায়ী, অনুষ্ঠানের আগে স্থানীয় কয়েকজন পরিচিতের সঙ্গে তিনি একটি ইয়টে সমুদ্র ভ্রমণে যান। সেখানেই সাঁতারের সময় দুর্ঘটনা ঘটে। তাঁকে দ্রুত সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও, চিকিৎসকদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ভারতীয় সময় দুপুর ২:৩০ নাগাদ তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। (সূত্র: দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া)

এই খবর আসামে পৌঁছতেই রাজ্যজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে দেশের সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র জগতের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শোক প্রকাশ করেন।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সক্রিয় উদ্যোগে, সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২১ সেপ্টেম্বর, রবিবার, জুবিনের মরদেহ বিশেষ বিমানে প্রথমে দিল্লী এবং পরে গুয়াহাটিতে নিয়ে আসা হয়। বিমানবন্দরে শিল্পীর স্ত্রী গরিমা শইকিয়া গর্গ এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। সেখান থেকে এক বিশাল কনভয়ে করে তাঁর মরদেহ প্রথমে কাহিলিপাড়ার বাসভবনে এবং পরে জনসাধারণের শ্রদ্ধার জন্য সারুসজাই স্পোর্টস কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়।

জনজোয়ার এবং রেকর্ডের দাবি

রবিবার সকাল থেকে গুয়াহাটির রাস্তাঘাট জুবিন অনুরাগীদের দখলে চলে যায়। আসামের বিভিন্ন প্রান্ত, এমনকি পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো থেকেও মানুষ আসতে শুরু করেন। সারুসজাই স্টেডিয়ামের বাইরের সারি কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়। ভক্তরা ফুল, ব্যানার এবং তাঁদের প্রিয় শিল্পীর ছবি হাতে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেন। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন, অনেকে আবার জুবিনের জনপ্রিয় গান গেয়ে তাঁকে স্মরণ করেন।

এই বিশাল জনসমাগমের পরিপ্রেক্ষিতেই কয়েকটি আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যম, যেমন ‘নর্থইস্ট নাউ’ এবং ‘নিউজ এরিনা’, সোমবার সকালে রিপোর্ট প্রকাশ করে যে লিমকা বুক অফ রেকর্ডস এই সমাবেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

পরিসংখ্যান ও তুলনা:

১. দাবিকৃত সংখ্যা: বিভিন্ন রিপোর্টে এই সমাবেশে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৭০ লক্ষ থেকে ১ কোটির মধ্যে হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। উইকিপিডিয়ার একটি সম্পাদনায় সংখ্যাটি প্রায় ১ কোটি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (সূত্র: উইকিপিডিয়া, বৃহত্তম অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার তালিকা)

২. ঐতিহাসিক তুলনা: যদি এই দাবি সত্য হয়, তবে জুবিনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সি.এন. আন্নাদুরাই (১৯৬৯, প্রায় ১.৫ কোটি) এবং আয়াতুল্লাহ খোমেইনি (১৯৮৯, প্রায় ১ কোটি)-র মতো ব্যক্তিত্বদের শেষযাত্রার সঙ্গে একাসনে বসবে। (সূত্র: গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস)

৩. সরকারি অনুমান: গুয়াহাটি পুলিশ বা আসাম সরকারের পক্ষ থেকে ভিড়ের আকার নিয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি। সাধারণত এই ধরনের বিশাল জনসমাবেশে সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা অত্যন্ত কঠিন।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, লিমকা বুক অফ রেকর্ডসের মতো সংস্থার পক্ষ থেকে এত দ্রুত কোনো ঘটনার সত্যতা যাচাই করে স্বীকৃতি প্রদান করা বেশ অস্বাভাবিক। সাধারণত এর জন্য একটি দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও যাচাই প্রক্রিয়া থাকে। তাই এই দাবির সত্যতা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে।

 সরকারি প্রতিক্রিয়া

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এক শোকবার্তায় বলেন, “আজ আসাম তার অন্যতম প্রিয় সন্তানকে হারাল। জুবিন রাজ্যের জন্য কী ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাঁর কণ্ঠস্বর লক্ষ লক্ষ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করত। এই শূন্যতা কখনও পূরণ হবে না।” (সূত্র: দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া)

সঙ্গীত পরিচালক অনু মালিক, যিনি জুবিনের সঙ্গে কাজ করেছেন, স্মৃতিচারণ করে বলেন, “ও খুব নরম মনের মানুষ ছিল। আমাকে ওর স্বাস্থ্য সমস্যার কথা, ব্ল্যাকআউটের কথা বলত। আমি ওকে নিজের যত্ন নিতে বলেছিলাম। খবরটা শুনে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।” (সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস)

সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, জুবিন গর্গ শুধুমাত্র একজন গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন আসামের মানুষের আবেগ, পরিচয় এবং প্রতিবাদের প্রতীক। তাঁর গানের মাধ্যমে তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে একসূত্রে বেঁধেছিলেন। এই অভূতপূর্ব জনসমাগম সেই গভীর সংযোগেরই প্রতিফলন।

আসাম সরকার গুয়াহাটির কাছে কামারকুচি গ্রামে জুবিনের নামে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ১০ বিঘা জমি বরাদ্দ করেছে। সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। শিল্পীর নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে।

এই মর্মান্তিক ঘটনা এবং তার পরবর্তী জন-উচ্ছ্বাস প্রমাণ করে যে, জুবিন গর্গ আসামের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবেন। তবে লিমকা রেকর্ডের দাবিটির আনুষ্ঠানিক সত্যতা যাচাই হওয়ার পরেই এই বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করা সম্ভব হবে।

 

About Author