​শুধু উৎসব নয়, জানুন নবরাত্রির নয় দেবীর পেছনের অজানা কাহিনী।

Complete Guide to Nabadurga: নবরাত্রিতে মা দুর্গার নয় অবতার: প্রথমা থেকে নবমী পর্যন্ত এক এক দিনে এক এক রূপে পূজিত হন জগজ্জননীহিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী নবরাত্রিতে মা দুর্গার নয়টি পৃথক রূপের…

Srijita Chattopadhay

 

Complete Guide to Nabadurga: নবরাত্রিতে মা দুর্গার নয় অবতার: প্রথমা থেকে নবমী পর্যন্ত এক এক দিনে এক এক রূপে পূজিত হন জগজ্জননীহিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী নবরাত্রিতে মা দুর্গার নয়টি পৃথক রূপের আরাধনা করা হয়। আশ্বিন মাসের শুক্ল প্রতিপদ থেকে নবমী তিথি পর্যন্ত নয় দিন ধরে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপে পূজা করা হয়, যাদের একত্রে নবদুর্গা বলা হয়। ‘নবরাত্রি’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘নয় রাত্রি’, যেখানে প্রতিটি তিথিতে দেবী দুর্গা এক এক রূপে পূজিত হন।পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দেবী পার্বতীর দুর্গার রূপের এই নয়টি ভিন্ন রূপের সব গুণ বর্তমান দেবী দুর্গার মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে। দেবী দুর্গার এই নয়টি রূপের নামকরণ করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। শ্রী বরাহপুরাণে হরিহর ব্রহ্মা ঋষির দ্বারা রচিত দেবী কবচে এই নবদুর্গার বিবরণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

শৈলপুত্রী:

প্রথম দিনের দেবীনবরাত্রির প্রথম দিন প্রতিপদ তিথিতে দেবী দুর্গা শৈলপুত্রী রূপে পূজিত হন। দেবী শৈলপুত্রী গিরিরাজ হিমালয়ের কন্যা, তাই তাঁর নাম শৈলপুত্রী (শৈল অর্থাৎ পর্বত, পুত্রী অর্থাৎ কন্যা)। মায়ের অপর নাম পার্বতী, হৈমবতী, ভবানী, সতী এবং বৃষরূঢ়া।দেবী শৈলপুত্রীর দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল এবং বাম হস্তে পদ্ম বা কমল ফুল থাকে, তাই দেবীর অপর নাম শূলধারিণী। তাঁর মস্তকে অর্ধচন্দ্র শোভা পায় এবং তিনি নন্দী বৃষভের উপরে আসীন। পৌরাণিক কথা অনুযায়ী, দেবী শৈলপুত্রী পূর্বজন্মে দক্ষ প্রজাপতির কন্যা সতী ছিলেন। দক্ষের যজ্ঞে স্বামী শিবের অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করেন এবং পরজন্মে শৈলপুত্রী রূপে জন্মগ্রহণ করে ভগবান শিবকেই স্বামী রূপে বরণ করেন।দেবী শৈলপুত্রীর আরাধনায় পার্থিব বাঞ্ছিত বস্তু প্রাপ্তি হয় এবং সূর্যের অশুভ প্রভাব হ্রাস পায়। যোগী এই দিনে নিজের মনকে মূলাধার চক্রে স্থিত করে যোগ-সাধনা আরম্ভ করেন।

ব্রহ্মচারিণী:

দ্বিতীয় দিনের দেবীনবরাত্রির দ্বিতীয় দিন দ্বিতীয়া তিথিতে দেবী দুর্গা ব্রহ্মচারিণী রূপে পূজিত হন। ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ এখানে তপস্যা, তাই ব্রহ্মচারিণী অর্থাৎ তপস্বিনী বা তপশ্চারিণী। বেদ, তত্ত্ব এবং তপ হল ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ।দেবী ব্রহ্মচারিণীর রূপ জ্যোতিপূর্ণ ও অতি মহিমামণ্ডিত। তিনি দ্বিভুজা, তাঁর ডান হাতে জপমালা এবং বাম হাতে কমণ্ডলু থাকে। এই দেবীকে যোগিনী, সিদ্ধি, মুক্তি, মোক্ষ, শান্তি এবং সমৃদ্ধির দেবী বলে মানা হয়। ব্রহ্মচারিণী দেবীর আরাধনায় জ্ঞান, বিদ্যা এবং তপস্যার শক্তি বৃদ্ধি পায়।

চন্দ্রঘণ্টা:

তৃতীয় দিনের দেবীতৃতীয়া তিথিতে দেবী দুর্গা চন্দ্রঘণ্টা রূপে পূজিত হন। দেবীর মস্তকে অর্ধচন্দ্র ঘণ্টার ন্যায় অবস্থান করে, তাই দেবীকে চন্দ্রঘণ্টা নামে অভিহিত করা হয়। এই দেবী সৌন্দর্য, সাহস এবং বীরত্বের প্রতীক।দেবী চন্দ্রঘণ্টা দশভুজা এবং সিংহের উপরে উপবিষ্ট। তাঁর হাতে কমণ্ডলু, তরোয়াল, গদা, ত্রিশূল, ধনুর্বাণ, পদ্ম, জপমালা এবং ঘণ্টা থাকে। দেবী তাঁর ঘণ্টার ন্যায় প্রচণ্ড চণ্ড ধ্বনিতে দুরাচারী রাক্ষস, দানব, দৈত্যদের প্রকম্পিত করেন। শাস্ত্রমতে তাঁর পূজা করলে মনে শক্তিভাব জন্মায়।

বাড়িতে কালীর কোন রূপের পূজা করলে আপনার জীবন বদলে যাবে!

কুষ্মাণ্ডা:

চতুর্থ দিনের দেবীচতুর্থী তিথিতে দেবী দুর্গা কুষ্মাণ্ডা রূপে পূজিত হন। এই দেবী মূলত রোগ নিরাময় করেন এবং অষ্টভুজা ও অষ্টসিদ্ধিদাত্রী। দেবী কুষ্মাণ্ডা সিংহের উপর উপবিষ্ট এবং তাঁর শরীরের রং স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল।দেবীর এই রূপের আরাধনা করলে আয়ু, যশ, বল ও আরোগ্য বৃদ্ধি পায়। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী, কুষ্মাণ্ডা দেবী তাঁর সামান্য হাস্যে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করেছিলেন। তাই তাঁকে ব্রহ্মাণ্ডের আদি স্বরূপা ও আদি শক্তি বলা হয়।

স্কন্দমাতা:

পঞ্চম দিনের দেবীপঞ্চমী তিথিতে দেবী দুর্গা স্কন্দমাতা রূপে পূজিত হন। দেবী কার্তিকের জননী হওয়ায় তাঁকে স্কন্দমাতা বলা হয়। মূর্তিতে দেবীর কোলে ষড়ানন কার্তিককে দেখা যায়।দেবী স্কন্দমাতা চতুর্ভুজা এবং সিংহের উপর উপবিষ্ট। তাঁর দুই হাতে পদ্ম ফুল, একহাতে বরমুদ্রা এবং অপর হাতে কোলের শিশু কার্তিক থাকেন। দেবী মোক্ষের দ্বার উন্মুক্ত করেন, তাই ভক্তিভরে তাঁর আরাধনা করলে মোক্ষলাভ সম্ভব। এই দেবীর আরাধনায় মাতৃত্বের গুণাবলী এবং সন্তানের কল্যাণ লাভ হয়।

কাত্যায়নী:

ষষ্ঠ দিনের দেবীষষ্ঠী তিথিতে দেবী দুর্গা কাত্যায়নী রূপে পূজিত হন। প্রাচীন কিংবদন্তি অনুযায়ী, দেবী পার্বতী ঋষি কাত্যায়নের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে কাত্যায়নী নামে পরিচিতা হন। আবার অনেকে মনে করেন, ঋষি কাত্যায়ন সর্বপ্রথম দেবী পার্বতীর পূজা করেছিলেন, তাই দেবী কাত্যায়নী নামে অভিহিতা।পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এই রূপেই দেবী মহিষাসুর বধ করেন। দেবী কাত্যায়নী চতুর্ভুজা, তাঁর এক হাতে তরবারি, এক হাতে পদ্ম এবং অপর দুই হাতে বর ও অভয় মুদ্রা থাকে। তাঁর বাহন সিংহ। শাস্ত্রমতে এই দেবীর পূজা করলে অবিবাহিত মেয়েরা বিশেষ ফল লাভ করেন এবং বিবাহজনিত সমস্যার সমাধান হয়।

কালরাত্রি:

সপ্তম দিনের দেবীসপ্তমী তিথিতে দেবী দুর্গা কালরাত্রি রূপে পূজিত হন। এই রূপ দেবীর হিংস্র ও ভয়ঙ্কর রূপ। দেবী অতি ভীষণা, এলোকেশী এবং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। অন্যান্য রূপের মতো সিংহ নয়, এই দেবীর বাহন গাধা।অসুর শম্ভু এবং নিশম্ভুকে দেবী এই রূপে হত্যা করেন। মনে করা হয় কালরাত্রির পূজা করলে শত্রুর বিনাশ হয় এবং সকল ভয় ও সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অনেকে দেবীর এই বিশেষ রূপকে শুভঙ্করী নামেও ডাকেন কারণ তিনি ভক্তদের অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করেন।

মহাগৌরী:

অষ্টম দিনের দেবীঅষ্টমী তিথিতে দেবী দুর্গা মহাগৌরী রূপে পূজিত হন। এই দেবীকে শান্তি এবং বুদ্ধিমত্তার প্রতীক হিসাবে মানা হয়। দেবী মহাগৌরী শিবের মতো বৃষভের উপরে উপবিষ্ট এবং চতুর্ভুজা।দেবী মহাগৌরী অত্যন্ত ফর্সা ও সুন্দরী, তাই তাঁকে মহাগৌরী বলা হয়। তাঁর এক হাতে ত্রিশূল, এক হাতে ডমরু এবং অপর দুই হাতে বর ও অভয় মুদ্রা থাকে। এই রূপে দেবী মহাদেবের অর্ধাঙ্গিনী রূপে প্রকাশিত হন। দেবী মহাগৌরীর আরাধনায় পাপমুক্তি এবং পবিত্রতা লাভ হয়।

বিষ্ণুর পবিত্র প্রতিনিধি: শালগ্রাম শিলা পূজার সম্পূর্ণ গাইড

সিদ্ধিদাত্রী:

নবম দিনের দেবীনবমী তিথিতে দেবী দুর্গা সিদ্ধিদাত্রী রূপে পূজিত হন। এটি নবদুর্গার সর্বশেষ রূপ। সিংহবাহিনী দেবী সিদ্ধিদাত্রী চতুর্ভুজা। তাঁর একহাতে চক্র, একহাতে গদা এবং অপর দুই হাতে শঙ্খ ও পদ্ম থাকে।মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে, অনিমা, মহিমা, গরিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রকাম্য, ঈশিত্ব এবং বশিত্ব – এই অষ্ট সিদ্ধি প্রদানকারিণী এই দেবী। দেবী সিদ্ধিদাত্রী হলেন সিদ্ধি, সফলতাদাত্রী এবং পরিপূর্ণতা দাত্রী। তাঁর পূজা করলে যে কোনও কাজে সাফল্য অনিবার্য এবং সমস্ত মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়।

নবরাত্রির আধ্যাত্মিক তাৎপর্যনবরাত্রি কেবল একটি উৎসব নয়, এটি একটি গভীর আধ্যাত্মিক সাধনা। প্রতিটি দিনে ভিন্ন ভিন্ন দেবীর আরাধনার মাধ্যমে ভক্তরা নিজেদের অন্তর্নিহিত শক্তি জাগ্রত করেন। এই নয় দিনে যোগীরা মূলাধার চক্র থেকে শুরু করে সহস্রার চক্র পর্যন্ত সাত চক্রের সাধনা করেন।নবদুর্গার এই নয়টি রূপ আসলে আদ্যাশক্তির বিভিন্ন প্রকাশ, যা মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ন্ত্রণ করে। শৈলপুত্রী থেকে সিদ্ধিদাত্রী পর্যন্ত প্রতিটি রূপের নিজস্ব বিশেষত্ব এবং শক্তি রয়েছে, যা ভক্তদের জীবনে সমৃদ্ধি, শান্তি এবং মোক্ষ এনে দেয়।

পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, নবরাত্রি রাক্ষস মহিষাসুরের উপর দেবী দুর্গার বিজয় উদযাপন করে। নয় দিনের প্রচণ্ড যুদ্ধের পর দুর্গা দশম দিনে মহিষাসুরকে বধ করে পরাজিত করেন, যা মন্দের উপরে ভালোর বিজয়ের প্রতীক।বাঙালি ঐতিহ্যে নবরাত্রি এবং দুর্গাপূজার মধ্যে গভীর সংযোগ রয়েছে। যদিও অন্যান্য প্রদেশে নবরাত্রির সময় কঠোর উপবাস এবং নিয়মাবলী পালন করা হয়, বাঙালিরা এই সময়টি উৎসব এবং আনন্দের সাথে পালন করে। বাঙালির কাছে এই সময় দেবী দুর্গাই কন্যাসমা উমা হিসেবে পরিচিত।নবদুর্গার এই নয়টি রূপের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে মাতৃশক্তি কেবল এক রূপে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর উপস্থিতি অনুভব করা যায়। নবরাত্রির এই নয় দিনে প্রতিটি রূপের আরাধনার মাধ্যমে ভক্তরা সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করতে পারেন এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে মা দুর্গার আশীর্বাদ লাভ করতে পারেন।

About Author
Srijita Chattopadhay

সৃজিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক। তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি তার লেখা দ্বারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি তুলে ধরতে সদা উদ্যমী। সৃজিতার লেখার ধারা মূলত সাহিত্য, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে ঘিরে আবর্তিত হয়, যেখানে তিনি তার গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর নিবন্ধ ও প্রতিবেদনগুলি পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা তার বস্তুনিষ্ঠতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় বহন করে। সৃজিতা তার কর্মজীবনে ক্রমাগত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে বদ্ধপরিকর, যা তাকে বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।