সিপিএমের তরুণ নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক বিতর্কিত মন্তব্য দলের অভ্যন্তরে তীব্র বিভাজন তৈরি করেছে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়ার পর এই প্রথম তিনি এমন একটি পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়েছেন, যা নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। গত শনিবার পলাশী বাজারে তমন্না খাতুনের মৃত্যুর প্রতিবাদ সভায় তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বিরুদ্ধে অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে তিনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন।
কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার দিন তৃণমূলের বিজয়মিছিল থেকে নিক্ষিপ্ত বোমার আঘাতে সিপিএম সমর্থক পরিবারের নাবালিকা তমন্না খাতুনের মৃত্যু হয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিবাদে আয়োজিত সভায় মীনাক্ষী নাম উল্লেখ না করেই কুণাল ঘোষকে লক্ষ্য করে কুরুচিকর শব্দের ব্যবহার করেছেন। তার এই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে এবং রাজনৈতিক মহলে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
মীনাক্ষীর এই আচরণ নিয়ে সিপিএমের অভ্যন্তরে দুটি ভিন্ন মত তৈরি হয়েছে। একদিকে রয়েছেন তারা যারা মনে করেন সমাবেশের মেজাজ বুঝে তিনি সঠিক কাজই করেছেন। অন্যদিকে দলের একাংশ মনে করছেন দ্রুত কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে উত্থানের ফলে তার “মাথা ঘুরে গেছে” এবং “হিতাহিত জ্ঞান” হারিয়ে ফেলেছেন1। এই প্রশ্নটি বিশেষভাবে উত্থাপিত হচ্ছে কারণ মীনাক্ষী সদ্য যুব সংগঠন থেকে বিদায় নিয়ে দলের উচ্চতর কমিটিগুলিতে জায়গা করে নিয়েছেন।
রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম মীনাক্ষীর পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছেন, “তমন্নার মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর, ওই সমাবেশের মেজাজ দেখার পর এক জন বক্তাই ভাল বোঝেন, কী বলতে হবে।” উল্লেখযোগ্য যে, একই সভায় সেলিম নিজেও পরোক্ষভাবে একই ধরনের ভাষা ব্যবহারে জনতাকে উৎসাহিত করেছিলেন, যা অনেকে মীনাক্ষীকে আড়াল করার প্রয়াস বলে মনে করছেন।
তবে ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও সিপিএম আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নিন্দা প্রস্তাব পাস করেনি। এটি স্পষ্ট করে যে দলগতভাবে সিপিএম মনে করছে না মীনাক্ষী কোনো ভুল করেছেন। এই অবস্থান দলের অভ্যন্তরীণ বিতর্ককে আরও তীব্র করে তুলেছে।
মীনাক্ষীর সমর্থকরা প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একটি উক্তি টেনে এনেছেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন “ওরা যে ভাষা বোঝে, সেই ভাষাতেই ওদের জবাব দিতে হবে”। কিন্তু দলের সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন যে বুদ্ধদেব কখনো প্রকাশ্য সভায় এমন ভাষা ব্যবহার করেছেন কিনা। তারা ২০০৯ সালে হুগলির অনিল বসুর অশ্রাব্য বক্তৃতার পর বুদ্ধদেবের তাৎক্ষণিক সেন্সর নোটিসের উদাহরণ দিয়েছেন।
আবার কেউ কেউ বামফ্রন্টের প্রথম অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্রের “আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিস্ট” – এই উক্তিকে সামনে এনেছেন। তবে দলের প্রবীণ নেতারা মনে করছেন এই প্রসঙ্গ টানা ভুল, কারণ জ্যোতি বসু লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি করে এসেও কখনো মঞ্চে দাঁড়িয়ে অপশব্দ ব্যবহার করেননি।
সিপিএমের অনেকে একান্ত আলোচনায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে মীনাক্ষীকে অনুসরণ করে স্থানীয় স্তরের তরুণ নেতারাও এই ধরনের ভাষা ব্যবহার শুরু করতে পারেন, যা “সংক্রামক” হয়ে উঠতে পারে। তাদের মতে এটি স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে হিতে বিপরীত হতে পারে।
চল্লিশের কোঠায় পৌঁছানোর আগেই মীনাক্ষী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছেন, যা সিপিএমের ইতিহাসে বিরল। এপ্রিলে তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ে অনুষ্ঠিত পার্টি কংগ্রেসে তিনি প্রেসিডিয়ামে স্থান পেয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। এই দ্রুত উত্থান নিয়েও দলের অভ্যন্তরে প্রশ্ন উঠেছে।
কুণাল ঘোষ মীনাক্ষীর মন্তব্যের জবাবে বলেছেন, “যিনি ওই কু-মন্তব্য করেছেন, বয়সে আমার চেয়ে ছোট। এটাই সিপিএমের সংস্কৃতি।” তিনি আরও বলেছেন যে মীনাক্ষী তার জন্ম পরিচয় নিয়ে যা বলেছেন, তার বাপ-ঠাকুরদার কাছ থেকে সত্য জেনে আসা উচিত।
সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছেন যে রাজনৈতিক কর্মীদের শব্দচয়নে সংযমী হওয়া প্রয়োজন। তবে দল নিন্দা না করায় প্রথম সারির অনেক নেতাই প্রকাশ্য মন্তব্য থেকে বিরত রয়েছেন।
একান্ত আলোচনায় কেউ কেউ বলছেন মীনাক্ষীর এই ভাষা “এক ধরনের ক্ষমতার ভাষা। যাতে সংসদীয় ছোঁয়া না-থাকলেও রয়েছে কমিটির সদস্য হওয়ার আস্ফালন।” এই মন্তব্য স্পষ্ট করে যে দলের অভ্যন্তরে মীনাক্ষীর দ্রুত উত্থান নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে।
আলিমুদ্দিন মনে করছে কয়েক দিন পরেই এই বিতর্ক থিতিয়ে যাবে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের এই যুগে অনেক কিছুই ফিরে আসে। দলের অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে মীনাক্ষীর এই “কুকথা” অসময়ে ফিরে আসতে পারে, যেমন এখনও ফিরে আসে অনিল বসু বা হরেকৃষ্ণ কোঙারদের বিতর্কিত মন্তব্য।
বর্তমানে সিপিএম প্রকাশ্যে মীনাক্ষীর বিষয়ে প্রশংসা বা নিন্দা কোনো দিকেই যেতে চাইছে না। এই পরিস্থিতি দলের অভ্যন্তরীণ দ্বিধাদ্বন্দ্বকেই প্রতিফলিত করে এবং তরুণ নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।