বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী ঐতিহাসিক রাজু ভাস্কর্যে একটি নতুন পরিবর্তন দেখা গেছে। ভাস্কর্যের মুক্তিযোদ্ধা নারী সৈনিকের মূর্তিতে হিজাব পরানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের টিএসসি এলাকায় অবস্থিত রাজু ভাস্কর্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের স্মরণে এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ভাস্কর্যের মূল আকর্ষণ হলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের মূর্তি, যার মধ্যে একজন নারী সৈনিকের মূর্তিও রয়েছে।
সম্প্রতি এই নারী সৈনিকের মূর্তিতে হিজাব পরানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মূর্তির মাথায় সাদা রঙের কাপড় দিয়ে হিজাবের মতো করে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনা নিয়ে নানা মহলে প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক শুরু হয়েছে।
ইউনূসের স্বৈরতন্ত্র: ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টায় ৮টি জাতীয় দিবস বাতিলের চাঞ্চল্যকর সিদ্ধান্ত
অনেকে মনে করছেন, এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাসের বিকৃতি। তাদের যুক্তি, মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী সৈনিকরা হিজাব পরতেন না। তাই ভাস্কর্যে হিজাব যোগ করা ঐতিহাসিক সত্যতার পরিপন্থী। অন্যদিকে কিছু মহল মনে করছেন, এটি ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সম্প্রতি নারী সৈনিকদের হিজাব পরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেনাবাহিনীর এডজুটেন্ট জেনারেলের অফিস থেকে জারি করা এক আদেশে বলা হয়েছে, ইচ্ছুক নারী সৈনিকরা তাদের পোশাকের সাথে হিজাব পরতে পারবেন। এর আগে সেনাবাহিনীতে হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারী সৈনিকদের অংশগ্রহণের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৭৪ সালে প্রথম নারী চিকিৎসক অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ২০০০ সালে প্রথম নারী কমিশন্ড অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে প্রথম নারী সৈনিক বাহিনী গঠন করা হয়। বর্তমানে প্রায় ১,৫০০ নারী সৈনিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছেন।
RG Kar Doctor Rape-Murder Case: বলিউড তারকাদের প্রতিবাদ: “নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়”
রাজু ভাস্কর্যের নারী সৈনিকের মূর্তিতে হিজাব পরানোর ঘটনাটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সাম্প্রতিক সামাজিক পরিবর্তনের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছে। একদিকে যেমন ঐতিহাসিক সত্যতা রক্ষার প্রশ্ন উঠেছে, অন্যদিকে ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিষয়টিও সামনে এসেছে।
এই ঘটনা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য এখনও পাওয়া যায়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানেরা এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করেছেন। তারা মনে করেন, এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সকল নাগরিকের ধর্ম পালন, আচরণ ও প্রচারের অধিকার রয়েছে”। এই অধিকারের আলোকে অনেকে মনে করছেন, নারী সৈনিকদের হিজাব পরার অধিকার থাকা উচিত।
তবে এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভে এই ধরনের পরিবর্তন করা কতটা যুক্তিযুক্ত। কারণ রাজু ভাস্কর্য শুধু একটি মূর্তি নয়, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এতে কোনো পরিবর্তন আনলে তা ইতিহাসের বিকৃতি হিসেবে দেখা হতে পারে।
বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এই ধরনের পরিবর্তন করার আগে ব্যাপক গবেষণা ও আলোচনা প্রয়োজন। তারা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ছবি ও দলিল পর্যালোচনা করে দেখতে হবে সেসময় নারী মুক্তিযোদ্ধারা কী ধরনের পোশাক পরতেন। সেই ঐতিহাসিক সত্যতার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
এদিকে, বাংলাদেশের নারী অধিকার সংগঠনগুলোও এই বিষয়ে মতামত দিয়েছে। তারা বলছেন, নারীর পোশাকের স্বাধীনতা থাকা উচিত। তবে ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভে এই ধরনের পরিবর্তন আনার আগে ব্যাপক সামাজিক আলোচনা প্রয়োজন।
রাজু ভাস্কর্যের এই ঘটনা বাংলাদেশের সমাজে চলমান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের একটি প্রতিফলন। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের সমাজে ধর্মীয় অনুশীলনের প্রভাব বেড়েছে। এর ফলে পোশাক-আশাকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। তবে এই পরিবর্তন যেন দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সংঘাতে না আসে, সেদিকে নজর রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সামগ্রিকভাবে, রাজু ভাস্কর্যের এই ঘটনা বাংলাদেশের সমাজে চলমান মূল্যবোধগত দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছে। একদিকে রয়েছে ঐতিহাসিক সত্যতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার প্রশ্ন, অন্যদিকে রয়েছে ধর্মীয় অনুভূতি ও ব্যক্তিগত পছন্দের স্বাধীনতার বিষয়। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সমন্বয় সাধন করাই হবে সমাজের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
শেষ পর্যন্ত, এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব পক্ষের মতামত নেওয়া ও ব্যাপক সামাজিক আলোচনা করা প্রয়োজন। একইসাথে, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। তাহলেই সমাজের সব অংশের মানুষের অনুভূতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সম্ভব হবে।