হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই নিজের পরিচিত বিস্ফোরক ভঙ্গিতে বারবার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে সাম্প্রতিক এক জনসভায় তার একটি মন্তব্য বিশ্বজুড়ে ভূ-রাজনৈতিক মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্পের দাবি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পূর্বসূরীর দুর্বল নীতির কারণে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দেশ—ভারত এবং রাশিয়াকে ‘গভীরতম, অন্ধকারতম চীনের’ (Deepest, Darkest China) কাছে কার্যত ‘হারিয়ে ফেলেছে’।
এই মন্তব্যটি কেবল ট্রাম্পের স্বভাবসিদ্ধ অতিশয়োক্তি নয়, বরং এটি একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে থাকা জটিল চ্যালেঞ্জগুলোর এক নগ্ন প্রতিফলন। কিন্তু ট্রাম্পের এই দাবির বাস্তবতা কতটুকু? ভারত কি সত্যিই মার্কিন বলয় ছেড়ে চীনের দিকে ঝুঁকছে? রাশিয়া-চীন অক্ষ কতটা শক্তিশালী? আসুন, আমরা তথ্য ও পরিসংখ্যানের মাধ্যমে এই জটিল সমীকরণের গভীরে প্রবেশ করি।
ট্রাম্পের মন্তব্যের নেপথ্যে: কেন এই উদ্বেগ?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই মন্তব্যকে বিশ্লেষণ করতে হলে তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির মূল দর্শন বুঝতে হবে। তার মতে, বিশ্ব রাজনীতি একটি জিরো-সাম গেম, যেখানে এক পক্ষের লাভ মানে অন্য পক্ষের ক্ষতি। তিনি মনে করেন, যে কোনো দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র অনুসারী না হলে, তারা শত্রু শিবিরে অবস্থান করছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি ভারতের স্বাধীন বিদেশ নীতি এবং রাশিয়ার সঙ্গে তার ঐতিহাসিক সম্পর্ককে ওয়াশিংটনের ‘পরাজয়’ হিসেবে দেখছেন।
তার এই বক্তব্যের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল পূর্ববর্তী বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসন। ট্রাম্প বোঝাতে চেয়েছেন যে, তাদের দুর্বল এবং দ্বিধান্বিত নীতির কারণেই বেইজিং বিশ্বমঞ্চে এতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে এবং মস্কো ও নয়াদিল্লিকে নিজেদের দিকে টানতে সক্ষম হয়েছে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে হোমিওপ্যাথি: কতটা কার্যকর? একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ
ভারতের বাস্তবতা: কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নাকি শিবির বদল?
ট্রাম্পের দাবির সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ হলো ভারতকে নিয়ে তার মন্তব্য। নয়াদিল্লি বরাবরই তার ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ (Strategic Autonomy) নীতির ওপর জোর দিয়ে এসেছে। ভারত কোনো একটি নির্দিষ্ট শিবিরে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে একাধিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে।
১. আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক: তথ্য বলছে, ভারত ও আমেরিকার সম্পর্ক দুর্বল হওয়ার পরিবর্তে গত কয়েক বছরে আরও বহুমুখী হয়েছে।
- বাণিজ্য: ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বর্তমানে প্রায় $২০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে (অর্থবর্ষ ২০২৪-২৫ এর अनुमान)। যদিও আমেরিকার প্রায় $৪০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, যা ট্রাম্পের বরাবরই মাথাব্যথার কারণ।
- প্রতিরক্ষা: চীনকে মোকাবিলা করার জন্য গঠিত কোয়াড (QUAD) জোটে ভারত আমেরিকার অন্যতম প্রধান সহযোগী। মালাবার নৌ-মহড়ার মতো যৌথ সামরিক অনুশীলন এবং অত্যাধুনিক মার্কিন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা—এই সবই শক্তিশালী সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। সম্প্রতি, জেট ইঞ্জিন প্রযুক্তি হস্তান্তরের মতো চুক্তি দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
২. ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক: ট্রাম্পের উদ্বেগের মূল কারণ ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
- জ্বালানি: ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মোট তেল আমদানির প্রায় ৩৫-৪০% আসছে রাশিয়া থেকে, যা দৈনিক প্রায় ১.৮ মিলিয়ন ব্যারেল। এই অর্থনৈতিক নির্ভরতা ওয়াশিংটনের অস্বস্তির কারণ।
- প্রতিরক্ষা: ভারতের সামরিক সরঞ্জামের একটি বড় অংশ (প্রায় ৫০%) এখনও রুশ বংশোদ্ভূত। S-400 মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কেনা নিয়ে আমেরিকার আপত্তি সত্ত্বেও ভারত নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে।
৩. ভারত-চীন সম্পর্ক: ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী, ভারত চীনের কাছে ‘ হেরে গেছে’—এই ধারণাটি বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না।
- সীমান্ত সংঘাত: ২০২০ সালের গালওয়ান উপত্যকার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর থেকে ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে। সীমান্তে এখনও উত্তেজনা বিরাজমান এবং হাজার হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে।
- অর্থনৈতিক নির্ভরতা: সীমান্ত সংঘাত সত্ত্বেও, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েই চলেছে। ভারত-চীন বাণিজ্য প্রায় $১৩৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি $১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এই বিপুল ঘাটতি ভারতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং এটি প্রমাণ করে যে অর্থনৈতিকভাবে চীনকে সম্পূর্ণ বয়কট করা নয়াদিল্লির পক্ষে কঠিন।
সুতরাং, ভারতকে ‘হারিয়ে ফেলা’র দাবিটি একটি অতিসরলীকরণ। ভারত আসলে আমেরিকা, রাশিয়া এবং অন্যান্য শক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে, যা ট্রাম্পের সাদা-কালো বিশ্ববীক্ষণের সঙ্গে খাপ খায় না।
চিনের নেটিজেনদের প্রতিক্রিয়া: প্রধানমন্ত্রী মোদির ৭ বছর পর প্রথম চীন সফর
রাশিয়া-চীন অক্ষ: এক নতুন মেরুকরণের জন্ম?
ট্রাম্পের বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ—রাশিয়াকে চীনের কাছে হারানোর বিষয়টি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা বিশ্বের একঘরে করে দেওয়ার প্রচেষ্টা রাশিয়াকে চীনের আরও কাছে ঠেলে দিয়েছে।
- অর্থনৈতিক বন্ধন: রাশিয়া ও চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় $২৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রাশিয়া এখন চীনের প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী দেশ। ‘পাওয়ার অফ সাইবেরিয়া’ গ্যাস পাইপলাইন এই সম্পর্কের প্রতীক।
- সামরিক সহযোগিতা: দুই দেশ নিয়মিত যৌথ সামরিক মহড়া চালাচ্ছে এবং পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে একটি متحدہ কূটনৈতিক অবস্থান নিয়েছে। তারা ব্রিকস (BRICS) এবং সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO)-এর মতো মঞ্চকে ব্যবহার করে ডলার-কেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প তৈরির চেষ্টা করছে।
এই ‘সীমাহীন বন্ধুত্ব’ (No-limits Friendship) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সরাসরি ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ও উপসংহার
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা ট্রাম্পের এই মন্তব্যকে তার ঘরোয়া রাজনীতির একটি অংশ হিসেবেই দেখছেন। দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হর্ষ ভি. পন্থের মতে, “ট্রাম্পের এই মন্তব্য ভারতের স্বাধীন বিদেশ নীতি সম্পর্কে তার অজ্ঞতারই পরিচয় দেয়। ভারত তার জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়, কোনো দেশকে খুশি করার জন্য নয়।”
অন্যদিকে, ওয়াশিংটনের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’ (CSIS)-এর এক বিশ্লেষক মনে করেন, “ট্রাম্পের ভাষা অতিরঞ্জিত হলেও তার মূল উদ্বেগটি অমূলক নয়। একটি শক্তিশালী রাশিয়া-চীন অক্ষ এবং ভারতের মতো নিরপেক্ষ শক্তিগুলির উত্থান আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্যকে নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।”
পরিশেষে বলা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যটি বিশ্ব রাজনীতির এক জটিল অধ্যায়ের দিকে আঙুল তুলেছে। বিশ্ব আর একমেরু বা দ্বিমেরু নয়, এটি এখন বহুমেরুকেন্দ্রিক। ভারত নিজের স্থান খুঁজে নিতে চাইছে এই নতুন ব্যবস্থায়। একে ‘হারিয়ে ফেলা’ হিসেবে দেখলে তা হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কৌশলগত ভুল। বরং এই পরিবর্তিত বাস্তবতাকে স্বীকার করে নতুন নীতি গ্রহণ করাই হবে ওয়াশিংটনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।