ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধের মেঘ ঘনীভূত হতে থাকলেও, দুই দেশের মধ্যে আসল যুদ্ধ যেন ডিজিটাল মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের অপারেশন সিন্দুর-এর পরে পাকিস্তান শুধু মিসাইল ও ড্রোন দিয়েই আক্রমণ করেনি, বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো তথ্য ও মিথ্যা ভিডিওর মাধ্যমে একটি সুপরিকল্পিত তথ্য যুদ্ধও শুরু করেছে। ঘটনা এতটাই ভয়াবহ যে, বড় বড় সংবাদমাধ্যমও এই ভুয়ো তথ্যের জালে আটকে পড়েছে এবং অযাচিত মিথ্যা খবর প্রচার করেছে। এই ডিজিটাল বিভ্রান্তি সৃষ্টি দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে এবং বিশ্ব জনমত প্রভাবিত করতে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের ডিজিটাল বিভ্রান্তি অভিযান
অপারেশন সিন্দুরের পর থেকে, পাকিস্তান সমর্থক বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট এবং সংবাদমাধ্যম নিয়মিতভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে চলেছে। বিশেষ করে, এসব অ্যাকাউন্ট পুরানো ভিডিও, কম্পিউটার গেমের দৃশ্য, এবং অন্যান্য সংঘর্ষের ছবি ব্যবহার করে ভারত-পাক যুদ্ধের নতুন ঘটনা হিসেবে প্রচার করছে। প্রায়শই, এসব মিথ্যা তথ্য এতটাই পেশাদারিভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, সাধারণ মানুষ সত্য-মিথ্যা বুঝতে হিমশিম খাচ্ছেন।
মিথ্যা দাবি ও বানোয়াট ভিডিও
পাকিস্তানি নেটওয়ার্কগুলো দাবি করছে যে তারা ২৫ থেকে ২৯টি ভারতীয় ড্রোন ধ্বংস করেছে। কিন্তু এই দাবি প্রমাণ করার জন্য কোনো বাস্তব প্রমাণ বা ভিডিও ফুটেজ উপস্থাপন করা হয়নি। জিও নিউজের মত পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমগুলো দাবি করেছে যে ভারত ইজরায়েলি-নির্মিত হারপ ড্রোন ব্যবহার করেছে, কিন্তু এর কোনো প্রমাণ নেই।
এছাড়াও, একটি ভারতীয় সামরিক পোস্ট ধ্বংসের দাবি করে একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে যেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। পিআইবি ফ্যাক্ট চেক বিভাগ জানিয়েছে যে ভিডিওটি বানোয়াট এবং ভারতীয় সেনায় “২০ রাজ ব্যাটালিয়ন” নামে কোনো ইউনিট নেই।
বিভ্রান্তিকর প্রচারের মূল ধরন
পাকিস্তানের ডিজিটাল বিভ্রান্তি অভিযানে বেশ কয়েকটি পদ্ধতি প্রধানভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে:
১. পুরাতন ছবি ও ভিডিও নতুন ঘটনা হিসেবে প্রচার
একটি ছবি ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয়েছে যেখানে দাবি করা হয় যে জম্মু বিমান ঘাঁটিতে একাধিক বিস্ফোরণ ঘটেছে। তবে, পিআইবি ফ্যাক্ট চেক পরিষ্কার করেছে যে ছবিটি আসলে আগস্ট ২০২১-এ কাবুল বিমানবন্দরে বোমা হামলার এবং বর্তমান ঘটনার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
একটি অন্য ভিডিও, যেখানে আকাশে মিসাইল উড়ে যাওয়া দেখানো হয়েছে, সেটি অনেক ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের দ্বারা প্রচারিত হয়েছে, যারা দাবি করেছে যে এটি বাহাওয়ালপুরে ভারতীয় আক্রমণ দেখাচ্ছে। যাইহোক, ফ্যাক্ট চেকারদের গবেষণায় দেখা গেছে যে ফুটেজটি আসলে অক্টোবর ২০২৩-এ গাজায় একটি ইজরায়েলি আক্রমণের।
২. বিদেশি সংঘর্ষের ফুটেজ ব্যবহার
বৃহস্পতিবার ভারতে পাকিস্তানি ড্রোন আক্রমণের দাবির মধ্যে, টেক্সাস অগ্নিকাণ্ডের একটি পুরানো ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। আরো একটি উদাহরণে, ২০২০ সালের বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরণের একটি ভিডিও পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক আক্রমণের প্রমাণ হিসেবে প্রচার করা হয়।
৩. ভিডিও গেম ফুটেজ বাস্তব হিসেবে প্রচার
একটি ব্যাপকভাবে শেয়ার করা ক্লিপ, যা পাকিস্তানি জেট দ্বারা ভারতীয় এলাকায় আক্রমণের দাবি করে, ব্যাটলফিল্ড ৩ ভিডিও গেমের ফুটেজ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
পিআইবি ফ্যাক্ট চেক বিভাগ একটি ভিডিও সম্পর্কে সতর্ক করেছে যেখানে একটি ভারী MLRS (মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেমস) ব্যারেজ দেখানো হয়েছে এবং এটিকে ভারতের উপর পাকিস্তানি আক্রমণ হিসেবে ভুল ভাবে শেয়ার করা হয়েছে। আসলে, ভিডিওটি একটি ভিডিও গেম থেকে নেওয়া এবং ৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনলাইনে ছিল।
ভারতীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা
দুঃখজনকভাবে, ভারতীয় সংবাদমাধ্যমও এই বিভ্রান্তির জালে আটকে পড়েছে। কয়েকটি সংবাদ চ্যানেল এবং সাংবাদিক ভুয়ো ভিডিও এবং দাবির শিকার হয়েছেন, যা একটি সময়ে অযাচিত তথ্য প্রচার করেছেন যখন সীমান্ত পারের আক্রমণ ও গোলাবারি, মক ড্রিল, এবং লাউডস্পিকার থেকে সাইরেন ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।
ব্যাপকভাবে প্রচারিত একটি ভিডিও – যেখানে রাতের আকাশে মিসাইল উড়ে যাওয়া দেখানো হয়েছে – একাধিক ভারতীয় সংবাদ চ্যানেল দ্বারা সম্প্রচারিত হয়েছে যারা দাবি করেছে যে এটি বাহাওয়ালপুরে ভারতীয় আক্রমণ দেখাচ্ছে। কিন্তু ফ্যাক্টচেকার অল্ট নিউজ জানিয়েছে যে ফুটেজটি ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় একটি ইজরায়েলি এয়ারস্ট্রাইকের।
পিআইবি ফ্যাক্ট চেক ইউনিটের ভূমিকা
গত কয়েকদিন ধরে, প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর ফ্যাক্ট চেক ইউনিট অবিরাম ভুয়ো খবর খণ্ডনের কাজে নিযুক্ত রয়েছে। এটি বানোয়াট ভিডিও এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ভুয়ো খবর প্রত্যাখ্যান করছে, যেগুলি দাবি করছে যে গুজরাটে ভারতের বন্দরে আক্রমণ করা হয়েছে, জালন্ধরে ড্রোন আক্রমণ হয়েছে, এবং জম্মু ও কাশ্মীরে আত্মঘাতী হামলা হয়েছে, এর মধ্যে অন্যান্য খবরও রয়েছে।
“৭ মে সকাল ৩টা থেকে তথ্যবিভ্রাটে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে,” পিআইবির একজন কর্মকর্তা হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেছেন। “আমরা প্রতিটি মিথ্যা মোকাবেলায় দিনরাত কাজ করছি।”
ভুয়ো জরুরি বিজ্ঞপ্তি এবং আতঙ্ক
ভারত সরকার আরেকটি তথ্যবিভ্রাটের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে – একটি ভুয়ো বিজ্ঞপ্তি যা অনলাইনে প্রচারিত হয়েছে এবং নাগরিক প্রতিরক্ষা প্রোটোকলের অনুকরণ করে প্রতীয়মান হয়েছে, নাগরিকদের খাদ্য ও ওষুধ সংগ্রহ করতে তাগিদ দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিটি কোন সরকারী সংস্থা দ্বারা জারি করা হয়নি। প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো এটিকে “ভুয়ো” হিসেবে লেবেল করেছে এবং নাগরিকদের সামরিক অপারেশন সম্পর্কে আপডেটের জন্য শুধুমাত্র অফিসিয়াল উৎসের উপর নির্ভর করার আহ্বান জানিয়েছে।
বাস্তব যুদ্ধের পরিস্থিতি
যখন ডিজিটাল ফ্রন্টে মিথ্যা তথ্যের যুদ্ধ চলছে, বাস্তবে ভারত-পাক সীমান্তে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ। বৃহস্পতিবার, ভারত সরকার জানিয়েছে যে তারা পাকিস্তানি প্রচেষ্টা সফলভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে, যেখানে পাকিস্তান ড্রোন ও মিসাইল দিয়ে ভারতীয় সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়, যার মধ্যে ডজন খানেক শহর ছিল, যেগুলির অনেকগুলিতে বিমানবাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে। ভারত বলেছে যে তারা লাহোরের কাছে পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও রাডার ইনস্টলেশন আক্রমণ করে জবাব দিয়েছে – একটি পদক্ষেপ যা বিশ্লেষকরা মনে করেন সামরিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে।
বুধবার, ভারত জানিয়েছে যে তাদের সামরিক বাহিনী পাকিস্তানে এবং বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলে নয়টি জায়গা লক্ষ্য করেছে। ভারতের আক্রমণের পরে, পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা ঘোষণা করেছেন যে তারা একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া শুরু করেছেন।
জনগণের জন্য সতর্কতা
এই সংকটপূর্ণ সময়ে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত প্রতিটি তথ্য সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনি সন্দেহজনক কন্টেন্ট দেখেন, বিশেষ করে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী বা চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কিত যেকোন তথ্য, আপনি অবশ্যই পিআইবি ফ্যাক্ট চেকে রিপোর্ট করুন। আপনি WhatsApp নম্বর 8799711259 এবং ইমেল আইডি-socialmedia@pib.gov.in এ এই ধরনের কন্টেন্ট শেয়ার করতে পারেন।
মিথ্যা তথ্য চিহ্নিতকরণের টিপস
ডিজিটাল বিভ্রান্তির এই যুগে, জনগণের জন্য কিছু টিপস যা সাহায্য করতে পারে:
- উৎস যাচাই করুন: কোনো ভিডিও বা ছবি শেয়ার করার আগে উৎস যাচাই করুন। অফিসিয়াল সরকারি চ্যানেল বা বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে তথ্য খুঁজুন।
- রিভার্স ইমেজ সার্চ: সন্দেহজনক ছবি বা ভিডিও দেখলে, রিভার্স ইমেজ সার্চ করে জেনে নিন সেগুলো কতদিন ধরে অনলাইনে আছে এবং কোথা থেকে এসেছে।
- ভাইরাল কন্টেন্ট সতর্কতার সাথে দেখুন: দ্রুত ভাইরাল হওয়া কন্টেন্ট আক্ষরিক অর্থে নিবেন না। অনেক সময় ভাইরাল কন্টেন্ট পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য তৈরি করা হয়।
- ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট ব্যবহার করুন: পিআইবি ফ্যাক্ট চেক, অল্ট নিউজ, এবং বিবিসি ভেরিফাই-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়মিত ভুয়ো তথ্য খণ্ডন করে।
উপসংহার
ভারত-পাক সংঘর্ষের সময় ভুয়ো তথ্যের প্রাদুর্ভাব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আধুনিক যুদ্ধ শুধু ক্ষেপণাস্ত্র এবং সৈন্য নিয়ে নয়, বরং তথ্য এবং প্রচারণাও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল মাধ্যমগুলি একটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করেছে যেখানে জনমত প্রভাবিত করা এবং বিপক্ষকে নৈতিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়।
এই সময়ে, সত্য যাচাই ও তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। সংকটপূর্ণ সময়ে, যখন ভুল তথ্য জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি করতে পারে, আমাদের সবার বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের সাবধানে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে, এবং বিশ্বাসযোগ্য উৎস থেকেই তথ্য গ্রহণ করতে হবে।