গুগল জেমিনি ন্যানো ব্যানানা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চার উত্তেজনাপূর্ণ ব্যবহার যা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে

প্রযুক্তি জগতে নতুন এক বিপ্লবের সূচনা ঘটেছে গুগলের সর্বশেষ উদ্ভাবন 'ন্যানো ব্যানানা' দিয়ে। গত ২৫ আগস্ট ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত এই অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলটি ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী ব্যবহারকারীদের মুগ্ধ করেছে তার…

Avatar

 

প্রযুক্তি জগতে নতুন এক বিপ্লবের সূচনা ঘটেছে গুগলের সর্বশেষ উদ্ভাবন ‘ন্যানো ব্যানানা’ দিয়ে। গত ২৫ আগস্ট ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত এই অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলটি ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী ব্যবহারকারীদের মুগ্ধ করেছে তার অসাধারণ সব ক্ষমতা দিয়ে। প্রকৃতপক্ষে ‘জেমিনি ২.৫ ফ্ল্যাশ ইমেজ’ নামে পরিচিত এই প্রযুক্তি মোবাইল ফোনেই চালানো যায় এবং ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াই কাজ করতে পারে।

কোডনাম ‘ন্যানো ব্যানানা‘ নামে পরিচিত এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলটি এলএম অ্যারেনা প্ল্যাটফর্মে প্রথম পরিচিতি পায়। ব্যবহারকারীরা প্রাথমিকভাবে জানতে পারেননি যে এটি গুগলের তৈরি, কিন্তু উৎপন্ন ছবিগুলোর মানের কারণে এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরবর্তীতে গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার টুইটারে কলার ইমোজি পোস্টের মধ্য দিয়ে রহস্য উদঘাটিত হয়। এই অভিনব প্রযুক্তি জেমিনি অ্যাপে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্যবহার করা যাচ্ছে।

প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যবহার হলো পেশাদার ছবি সম্পাদনার ক্ষেত্রে। বিপণন পেশাদার এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চমানের কাস্টমাইজড ছবি তৈরি করতে পারছেন। পণ্যের ছবি, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, বিজ্ঞাপন এবং ক্যাম্পেইনের জন্য প্রয়োজনীয় ভিজুয়াল কন্টেন্ট তৈরিতে এই প্রযুক্তি অসাধারণ সুবিধা প্রদান করছে। সাধারণ টেক্সট প্রম্পট ব্যবহার করে একটি ঘড়ির ডায়াল বর্গাকার করা বা স্ট্র্যাপের রঙ কালো করার মতো জটিল কাজ সহজেই সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় বিশেষ ব্যবহার পাওয়া যাচ্ছে সামাজিক গণমাধ্যমের কন্টেন্ট তৈরিতে। সোশ্যাল মিডিয়া কন্টেন্ট নির্মাতা এবং প্রভাবশালীরা বিভিন্ন স্টাইল এবং নান্দনিকতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারছেন। তাদের পোস্টগুলোকে সর্বশেষ ট্রেন্ড এবং ফলোয়ারদের পছন্দ অনুযায়ী কাস্টমাইজ করার সুবিধা পাচ্ছেন। একটি ছবিতে মুক্তোর কানের দুল যোগ করা, চোখের রঙ হালকা সবুজ করা বা ঠোঁটের রঙ গাঢ় লাল করার মতো সূক্ষ্ম পরিবর্তন মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই সম্ভব হচ্ছে।

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারক্ষেত্র হলো ব্র্যান্ডিং এবং ডিজাইন প্রকল্পে। ব্র্যান্ড এবং ডিজাইনাররা ধারাবাহিক ছবি সম্পাদনা, স্টাইল ট্রান্সফার বা একাধিক সম্পদ তৈরির জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন। কোনো রকম ম্যানুয়াল রিফাইনমেন্ট বা রিটাচিং ছাড়াই একাধিক ক্যাম্পেইন ভেরিয়েন্ট তৈরি করা যাচ্ছে। একটি ছবির রঙের থিম নীল এবং রুপালি করার মতো জটিল কাজ অবিশ্বাস্য গতিতে সম্পন্ন হয়ে থাকে।

চতুর্থ এবং সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে শিল্প এবং সৃজনশীল পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। সৃজনশীল শিল্পীরা স্টাইল ভেরিয়েশন, টেক্সচারাল ঠিক করা বা ট্রান্সফার এমনকি মাল্টি-স্টাইল ভেরিয়েন্ট তৈরির জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন। ডিজিটাল শিল্পকর্ম থেকে শুরু করে কনসেপ্ট আর্টে কাজ করা পর্যন্ত, শিল্পীরা নতুন করে শুরু না করেই তাদের সৃজনশীল সীমানা বিস্তৃত করতে পারছেন। রাতের দৃশ্যকে দিনের আলোতে পরিবর্তন করা বা গাছ থেকে লন্ঠন সরিয়ে নেওয়ার মতো কাজ সাধারণ প্রম্পট দিয়েই সম্ভব হচ্ছে।

গুগলের এই প্রযুক্তির অন্যতম বিশেষত্ব হলো এটি চরিত্রের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারে। অন্যান্য এআই মডেলের তুলনায় ন্যানো ব্যানানা ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ চরিত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম। এর ফলে মানুষের মুখ, পোষা প্রাণী বা গুরুত্বপূর্ণ বস্তুর আকৃতি একাধিক সম্পাদনার পরেও অপরিবর্তিত থাকে।

মাল্টি-টার্ন এডিটিং ন্যানো ব্যানানার আরেকটি অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য। ব্যবহারকারীরা প্রথমে একটি ছবি আপলোড করে কিছু সম্পাদনা করতে পারেন, তারপর সেই আপডেট হওয়া ছবিতে আরও সম্পাদনা যোগ করতে পারেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আগের নির্দেশাবলী মনে রাখে, যা এটিকে আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

ছবি মিশ্রণের ক্ষমতাও এই প্রযুক্তির একটি অসাধারণ দিক। একাধিক ছবি আপলোড করে আলো, ছায়া বা পটভূমি সমন্বয় করার জন্য প্রম্পট টাইপ করলে জেমিনি ২.৫ ফ্ল্যাশ ইমেজ একটি চমৎকার প্রতিকৃতি তৈরি করে। এটি স্টাইলিস্টিক সামঞ্জস্য এবং আখ্যানমূলক সারিবদ্ধতা নিশ্চিত করে।

প্রযুক্তিটির ব্যবহার শুধু ইন্টারনেট-সংযুক্ত ডিভাইসেই সীমাবদ্ধ নয়। জেমিনি ন্যানো অ্যান্ড্রয়েড ফোনেও কাজ করতে পারে এবং অফলাইন অবস্থায়ও এআই-চালিত কার্যক্রম সম্পাদন করতে সক্ষম। গোপনীয়তা রক্ষা এবং ডেটা নিরাপত্তার দিক থেকে এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সংবেদনশীল তথ্য ডিভাইসেই প্রক্রিয়া হয় এবং ক্লাউড সার্ভারে পাঠানোর প্রয়োজন নেই।

বর্তমানে গুগল পিক্সেল ৮ এবং পিক্সেল ৯ সিরিজের ডিভাইসগুলোতে জেমিনি ন্যানো ব্যবহার করা যাচ্ছে। এছাড়াও স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২৪ সিরিজ, মোটোরোলা এজ ৫০ আল্ট্রা, শাওমি ১৪টি প্রো সহ আরও অনেক হাই-এন্ড স্মার্টফোনে এই প্রযুক্তি উপলব্ধ।

এলএম অ্যারেনায় ১৩৬২ ইএলও স্কোর নিয়ে ন্যানো ব্যানানা শীর্ষস্থানীয় ইমেজ এডিটিং মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জিপিটি-৪ও এবং কিউয়েনের মতো প্রতিযোগীদের তুলনায় এটি নির্ভুলতা এবং গতির দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে।

গুগল এই প্রযুক্তিতে দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য উভয় ধরনের ওয়াটারমার্ক যুক্ত করেছে। প্রতিটি এআই-উত্পন্ন ছবিতে গুগলের সিনথআইডি ওয়াটারমার্ক থাকে, যা স্বচ্ছতা এবং সত্যতা নিশ্চিত করে। এটি বিশেষভাবে পেশাদার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যেখানে সত্যতা গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাথমিক ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, ন্যানো ব্যানানা ঐতিহ্যবাহী ইমেজ এডিটিং টুলের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময়, অর্থ এবং প্রচেষ্টা সাশ্রয় করে। ঘন্টার কাজ এখন কয়েক মিনিটেই সম্পন্ন হচ্ছে। এটি কঠোর নির্দেশিকা এবং কঠিন সময়সীমার মধ্যে কাজ করা পেশাদারদের জন্য একটি আদর্শ সমাধান।

গবেষক এবং ডেভেলপাররা এই প্রযুক্তিকে ফটোশপ কিলার হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করেছেন। এর স্বাভাবিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতার কারণে কোনো পেশাদার সম্পাদনার দক্ষতা ছাড়াই যে কেউ জটিল ইমেজ এডিটিং করতে পারেন।

প্রযুক্তিটি বর্তমানে বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য, তবে অধিক ব্যবহার এবং জটিল সম্পাদনার জন্য গুগল পেইড প্ল্যানের ব্যবস্থা রেখেছে। এপিআই ব্যবহারের জন্য প্রতি মিলিয়ন ইনপুট টোকেনের জন্য ০.৩০ ডলার এবং প্রতি মিলিয়ন আউটপুট টোকেনের জন্য ২.৫০ ডলার খরচ হয়।

ভবিষ্যতে গুগল এই প্রযুক্তিতে আরও ভাষার সাপোর্ট যোগ করার পাশাপাশি অডিও ইনপুটের সুবিধা যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়াও আরও বেশি ডিভাইসে এই প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে।

এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতি কেবল একটি টুল নয়, বরং এটি সৃজনশীল শিল্প এবং ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। ন্যানো ব্যানানার মাধ্যমে গুগল প্রমাণ করেছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধুমাত্র পেশাদারদের জন্যই নয়, সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্যও শক্তিশালী সৃজনশীল হাতিয়ার হতে পারে।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম