চোখ দেখে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি চেনার ৪ লক্ষণ: জীবন বাঁচাতে পারে এই গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা

Debolina Roy 7 Min Read

heart attack risk eye signs: চোখ কেবল দর্শনের জানালা নয়, এটি আমাদের হৃদয়ের স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচকও বটে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি সবার আগে প্রকাশ পায় আমাদের চোখে। ভারতীয় জনসংখ্যার মধ্যে হৃদরোগের ক্রমবর্ধমান প্রকোপ এবং হার্ট অ্যাটাকের ক্রমবর্ধমান ঘটনার কারণে এই বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, চোখের রেটিনায় সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি নির্ধারণে অগ্রিম সতর্কবার্তা দিতে পারে। এই গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণগুলি চিনে নিতে পারলে আপনি সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করে একটি বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারেন।

হৃদয় ও চোখের মধ্যে গভীর সংযোগ

আমাদের চোখ এবং হৃদয়ের মধ্যে একটি গভীর শারীরবৃত্তীয় সংযোগ রয়েছে। চোখের রেটিনায় অবস্থিত রক্তনালিগুলি শরীরের মাইক্রোভাসকুলার সিস্টেমের একমাত্র অংশ যা সরাসরি দেখা যায়। এই ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলির স্বাস্থ্য আমাদের সমগ্র হৃদযন্ত্রের অবস্থার প্রতিফলন ঘটায়।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং কোলেস্টেরলের সমস্যা প্রথমে চোখের রক্তনালিগুলিতে ক্ষতি করে। এই ক্ষতি পরবর্তীতে হৃদয়ের করোনারি আর্টারিতে একই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে, যা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

১. রেটিনাল আর্টারি সংকীর্ণতা: রক্তনালির সূক্ষ্ম সংকোচন

চোখে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকির প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হল রেটিনাল আর্টারির সংকীর্ণতা। এই অবস্থায় চোখের রেটিনায় অবস্থিত ছোট রক্তনালিগুলি ক্রমশ সরু হয়ে যায়।

লক্ষণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি

উচ্চ রক্তচাপ এবং এথেরোস্ক্লেরোসিসের কারণে রেটিনাল আর্টারিগুলি তাদের স্বাভাবিক ব্যাস হারায়। একটি বৃহৎ গবেষণায় দেখা গেছে যে, রেটিনাল আর্টারির ব্যাস প্রতি এক স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন কমে গেলে মহিলাদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৩৭% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।

চিহ্নিতকরণের পদ্ধতি

এই সংকীর্ণতা সাধারণত চোখের বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়ে। আধুনিক এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে রেটিনাল ইমেজিং এর মাধ্যমে ৭০% নির্ভুলতার সাথে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব।

দৌড়ের সময় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি: সতর্কতা ও প্রতিরোধের উপায়

২. কর্নিয়াল আর্কাস: চোখের পাতার চারপাশে ধূসর বলয়

কর্নিয়াল আর্কাস হল চোখের কর্নিয়ার চারপাশে একটি ধূসর-সাদা বলয়ের মতো দাগ। এটি কোলেস্টেরল জমার কারণে হয় এবং বিশেষত ৫০ বছরের কম বয়সে দেখা দিলে এটি হৃদরোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা।

কোলেস্টেরল সমস্যার সূচক

কর্নিয়াল আর্কাস মূলত লিপিড জমার ফলে তৈরি হয়। ৫০ বছরের কম বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে এই লক্ষণ দেখা দিলে এটি হাইপারলিপিডেমিয়া এবং প্রিম্যাচিউর করোনারি আর্টারি ডিজিজের সংকেত দেয়।

গবেষণার তথ্য

ভারতীয় রোগীদের উপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, কর্নিয়াল আর্কাস থাকা রোগীদের ৭৮.৩% ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য করোনারি আর্টারি ডিজিজ পাওয়া গেছে। এমনকি যাদের সাধারণ করোনারি থেকেছে, তাদের ৭৩.৩% ক্ষেত্রে স্লো ব্লাড ফ্লো পাওয়া গেছে।

৩. জ্যান্থেলাজমা: চোখের পাতায় হলুদ রঙের প্রলেপ

জ্যান্থেলাজমা হল চোখের পাতার উপর বা নিচে হলুদাভ, চ্যাপ্টা প্রলেপের মতো গুটি। এগুলি কোলেস্টেরল ও অন্যান্য ফ্যাট জমার কারণে হয় এবং হৃদরোগের একটি স্বাধীন ঝুঁকির কারণ হিসেবে বিবেচিত।

হৃদরোগের সাথে সরাসরি সম্পর্ক

কোপেনহেগেন সিটি হার্ট স্টাডিতে ১২,৭৪৫ জন অংশগ্রহণকারীর উপর ৩৩ বছরের দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় দেখা গেছে যে, জ্যান্থেলাজমা থাকা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে:

  • মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের ঝুঁকি ৪৮% বেশি
  • ইস্কেমিক হৃদরোগের ঝুঁকি ৩৯% বেশি
  • মৃত্যুর ঝুঁকি ১৪% বেশি

বয়স ও লিঙ্গ ভিত্তিক ঝুঁকি

৭০-৭৯ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে জ্যান্থেলাজমা থাকলে ১০ বছরে ইস্কেমিক হৃদরোগের ঝুঁকি ৫৩% পর্যন্ত বেড়ে যায়। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি ৩৫%।

৪. রেটিনাল ইস্কেমিক পেরিভাসকুলার লেশন (RIPL): লুকানো ক্ষতির চিহ্ন

RIPL হল চোখের রেটিনার মধ্যবর্তী স্তরে সূক্ষ্ম ইস্কেমিক ক্ষতের চিহ্ন। এগুলি অপটিক্যাল কোহেরেন্স টোমোগ্রাফি (OCT) স্ক্যানের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায় এবং হৃদরোগের একটি নতুন বায়োমার্কার হিসেবে বিবেচিত।

ইস্কেমিয়ার প্রাথমিক সংকেত

RIPL গুলি মূলত রেটিনার গভীর ক্যাপিলারি প্লেক্সাসে রক্ত সরবরাহ কমে যাওয়ার ফলে তৈরি হয়। এটি হৃদযন্ত্রের অনুরূপ ইস্কেমিক পরিবর্তনের প্রতিফলন।

গবেষণার ফলাফল

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে:

অতিরিক্ত সতর্কতার লক্ষণসমূহ

ল্যান্ডোলফি সাইন: চোখের মণির স্পন্দন

এটি একটি বিরল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ যেখানে চোখের মণি হৃদস্পন্দনের সাথে তাল মিলিয়ে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। এটি গুরুতর অ্যাওর্টিক রেগার্জিটেশনের সংকেত যা হার্ট ফেইলিউরের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

কটন উল স্পটস: রেটিনার সাদা দাগ

রেটিনায় ছোট সাদা দাগের মতো ক্ষত, যা কটন উল স্পটস নামে পরিচিত, এগুলি রেটিনার রক্তনালিতে ইস্কেমিয়ার ফলে তৈরি হয়। এই লক্ষণ হার্ট অ্যাটাকের পরে ৫৭% ক্ষেত্রে দেখা যায়।

প্রতিরোধ ও সতর্কতা

নিয়মিত চোখের পরীক্ষা

৪০ বছর বয়সের পর প্রতি বছর একবার বিস্তারিত চোখের পরীক্ষা করানো উচিত। বিশেষত যাদের পারিবারিক ইতিহাসে হৃদরোগ আছে, তাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে।

জীবনযাত্রার পরিবর্তন

  • নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
  • ধূমপান ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান বর্জন
  • রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা
  • ডায়াবেটিস থাকলে তা সুনিয়ন্ত্রিত রাখা

আর্লি ডিটেকশনের গুরুত্ব

এই লক্ষণগুলি চিহ্নিত হওয়ার পর অবিলম্বে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। যথাসময়ে চিকিৎসা নিলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।

আধুনিক প্রযুক্তির ভূমিকা

এআই ভিত্তিক স্ক্রিনিং

বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে রেটিনাল ইমেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি নির্ণয় করা সম্ভব। এই প্রযুক্তি মাত্র কয়েক সেকেন্ডে ৭০% নির্ভুলতার সাথে ঝুঁকি নির্ধারণ করতে পারে।

অপটিক্যাল কোহেরেন্স টোমোগ্রাফি

OCT স্ক্যান এখন রুটিন চোখের পরীক্ষার অংশ হয়ে উঠেছে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে RIPL সহ অন্যান্য সূক্ষ্ম পরিবর্তন সহজেই শনাক্ত করা যায়।

চোখ দেখে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি চেনার এই চারটি প্রধান লক্ষণ – রেটিনাল আর্টারি সংকীর্ণতা, কর্নিয়াল আর্কাস, জ্যান্থেলাজমা এবং RIPL – আমাদের হৃদয়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কে অগ্রিম সতর্কতা প্রদান করে। এই লক্ষণগুলি সম্পর্কে সচেতনতা এবং নিয়মিত চোখের পরীক্ষা জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।মনে রাখবেন, প্রতিরোধ সবসময় চিকিৎসার চেয়ে ভালো। চোখের এই সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করে যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলে একটি সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব।

Share This Article