History of the London Underground: ১৮৬৩ সালের ৯ জানুয়ারি লন্ডনের মেট্রোপলিটন রেলওয়ে চালু হয়ে বিশ্বের প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ে হিসেবে ইতিহাস রচনা করে। এই ঐতিহাসিক দিনে প্যাডিংটন থেকে ফ্যারিংডন পর্যন্ত ৩.৭৫ মাইল দীর্ঘ রুটে প্রথম যাত্রা শুরু করে মেট্রোপলিটন রেলওয়ে। প্রথম দিনেই ৩৮,০০০ যাত্রী ভ্রমণ করেন এই নতুন ধরনের পরিবহন ব্যবস্থায়। প্রথম বছরে ৯.৫ মিলিয়ন এবং দ্বিতীয় বছরে ১২ মিলিয়ন যাত্রী পরিবহন করে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড।
১৯ শতকের লন্ডনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে যানজট সমস্যা তীব্র হয়ে ওঠে। শহরের কেন্দ্রস্থলে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের যাতায়াতের চাপ সামলাতে গিয়ে রাস্তাঘাট ভীষণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সমস্যার সমাধানে ১৮৩০ এর দশক থেকেই আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ের ধারণা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। চার্লস পিয়ারসন নামে সিটি অব লন্ডনের একজন সলিসিটর এই ধারণার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন। তিনি ১৮৫২ সালে সিটি টার্মিনাস কোম্পানি গঠন করেন ফ্যারিংডন থেকে কিংস ক্রস পর্যন্ত একটি আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ে নির্মাণের লক্ষ্যে।১৮৫৪ সালে মেট্রোপলিটন রেলওয়েকে আন্ডারগ্রাউন্ড লাইন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু ক্রিমিয়ান যুদ্ধের কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে দেরি হয়। অবশেষে ১৮৬০ সালের মার্চ মাসে নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
Bangladesh Metro Rail: মেট্রো রেলের ক্ষতি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন শেখ হাসিনা
প্যাডিংটন থেকে কিংস ক্রস পর্যন্ত অংশ “কাট-অ্যান্ড-কভার” পদ্ধতিতে নির্মাণ করা হয়। কিংস ক্রস থেকে পূর্বদিকে টানেলিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড চালু হওয়ার পর থেকেই এর জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্তমানে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের ১১টি লাইনে মোট ২৭২টি স্টেশন রয়েছে। নেটওয়ার্কের মোট দৈর্ঘ্য ৪০২ কিলোমিটার। প্রতিদিন গড়ে ৫ মিলিয়ন যাত্রী ভ্রমণ করেন লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডে।লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের সাফল্য বিশ্বের অন্যান্য বড় শহরগুলোকেও মেট্রো রেল সিস্টেম তৈরিতে অনুপ্রাণিত করেছে। পরবর্তীতে ইস্তানবুল (১৮৭৫), শিকাগো (১৮৯২), গ্লাসগো (১৮৯৬), বুদাপেস্ট (১৮৯৬), প্যারিস (১৯০০) সহ বিভিন্ন শহরে মেট্রো রেল চালু হয়।
লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড শুধু পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবেই নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এর লোগো, স্টেশনের নকশা, ম্যাপ ইত্যাদি লন্ডনের পরিচয় হিসেবে বিবেচিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনগুলো জার্মান বোমা হামলা থেকে আশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো।লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডনের একজন প্রতিনিধি বলেন, “লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড শুধু একটি পরিবহন ব্যবস্থা নয়, এটি লন্ডনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গত ১৫০ বছর ধরে এটি লন্ডনের অর্থনীতি ও সমাজকে চালিত করেছে। আমরা গর্বিত যে আমরা বিশ্বের প্রথম ও সবচেয়ে পুরনো মেট্রো সিস্টেমের অংশ।”
লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের প্রভাব শুধু লন্ডনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর সাফল্য বিশ্বের অন্যান্য শহরগুলোকেও অনুরূপ পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ২০০ এরও বেশি শহরে মেট্রো রেল সিস্টেম রয়েছে।তবে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের সামনে চ্যালেঞ্জও কম নেই। পুরনো অবকাঠামো আধুনিকায়ন, যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মেলানো, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়মিত মোকাবেলা করতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের একজন কর্মকর্তা জানান, “আমরা নিয়মিত সিস্টেম আপগ্রেড করছি, নতুন ট্রেন যোগ করছি এবং স্টেশনগুলো আধুনিকায়ন করছি। আমাদের লক্ষ্য হলো যাত্রীদের আরও দ্রুত, নিরাপদ ও আরামদায়ক পরিবহন সেবা দেওয়া।”লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, “আমরা ২০৪০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ককে কার্বন নিরপেক্ষ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।
এছাড়া আরও বেশি স্টেশনে লিফট ও এস্কেলেটর স্থাপন করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সহজগম্যতা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।”লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের ১৫০ বছরের ইতিহাসে নানা উত্থান-পতন এসেছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা, সন্ত্রাসী হামলা – সব কিছু মোকাবেলা করে এটি টিকে আছে। বর্তমানে প্রতিদিন লাখো মানুষের যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড শহরের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৩ সালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই উপলক্ষে তৎকালীন মেয়র বরিস জনসন বলেছিলেন, “লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড আমাদের শহরের প্রাণ।
রেলপথের রক্তাক্ত অধ্যায়: ভারতের পাঁচটি মর্মান্তিক ট্রেন বিপর্যয়
এটি শুধু মানুষকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায় না, এটি লন্ডনকে একসূত্রে বেঁধে রাখে।”বিশ্বের প্রথম মেট্রো হিসেবে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড শুধু ইংল্যান্ডের জন্যই নয়, সারা বিশ্বের জন্য গর্বের। এর সাফল্য অন্যান্য দেশগুলোকে অনুপ্রাণিত করেছে নিজেদের শহরে আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। আজ থেকে ১৬০ বছর আগে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজও অব্যাহত রয়েছে – প্রতিনিয়ত নিজেকে আধুনিক করে তুলে লন্ডনবাসীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড শুধু একটি পরিবহন ব্যবস্থা নয়, এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস যা লন্ডনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে সংযুক্ত করে রেখেছে।