আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) ক্রিকেট জগতে এক যুগান্তকারী ইতিহাস রচনা করেছে। প্রথমবারের মতো মহিলাদের বিশ্বকাপে সম্পূর্ণ মহিলা আম্পায়ার ও ম্যাচ রেফারিদের নিয়ে প্যানেল গঠন করা হয়েছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিতব্য মহিলাদের একদিনের বিশ্বকাপে ১৪ জন মহিলা আম্পায়ার ও চারজন মহিলা ম্যাচ রেফারি দায়িত্ব পালন করবেন। ২০২২ সালের কমনওয়েলথ গেমস এবং গত দুটি মহিলাদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সব মহিলা ম্যাচ অফিশিয়াল প্যানেল থাকলেও পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপে এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটল।
আইসিসির এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তারা রয়েছেন। আম্পায়ারদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ক্লেয়ার পলোস্যাক, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জ্যাকুলিন উইলিয়ামস এবং ইংল্যান্ডের সু রেডফার্ন তৃতীয়বার মহিলাদের বিশ্বকাপে দায়িত্ব পালন করবেন। দক্ষিণ আফ্রিকার লরেন এজেনবাগ ও নিউজিল্যান্ডের কিম কটন ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ার সপ্তম খেতাব জয়ের ফাইনালে দায়িত্ব পালনের পর দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করবেন।
ম্যাচ রেফারিদের দলে রয়েছেন নিউজিল্যান্ডের ট্রুডি অ্যান্ডারসন, দক্ষিণ আফ্রিকার শান্দ্রে ফ্রিৎজ, ভারতের জি.এস. লক্ষ্মী এবং শ্রীলঙ্কার মিশেল পেরেইরা। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, জি.এস. লক্ষ্মী ২০১৯ সালে আইসিসির আন্তর্জাতিক প্যানেলে প্রথম মহিলা ম্যাচ রেফারি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তিনি ১৯৮৬ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত আন্ধ্র ও বিহারের পক্ষে খেলেছেন এবং ২০০৮-০৯ সালে ঘরোয়া মহিলা ক্রিকেটে ম্যাচ রেফারি হিসেবে দায়িত্ব শুরু করেছিলেন।
এই প্যানেলে ভারতীয় তিনজন প্রাক্তন ক্রিকেটারও রয়েছেন। আম্পায়ারদের মধ্যে বৃন্দা রাঠি, এন জানানী এবং গায়ত্রী ভেনুগোপালন অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের শাথিরা জাকির জেসিও এই ঐতিহাসিক প্যানেলের অংশ হয়ে দেশের জন্য গর্ব এনেছেন। ৩৪ বছর বয়সী শাথিরা হবেন প্রথম বাংলাদেশি মহিলা আম্পায়ার যিনি সিনিয়র আইসিসি বিশ্বকাপে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রাক্তন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেটার থেকে আম্পায়ার হওয়া শাথিরার এই অর্জন বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের জন্য একটি মাইলফলক।
আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহ এই সিদ্ধান্তকে মহিলাদের ক্রিকেটে একটি নির্ধারক মুহূর্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “এটি মহিলাদের ক্রিকেটের যাত্রায় একটি নির্ধারক মুহূর্ত, যা আমরা আশা করি খেলার সব ক্ষেত্রে আরও অনেক অগ্রগামী গল্পের পথ প্রশস্ত করবে। সম্পূর্ণ মহিলা ম্যাচ অফিশিয়াল প্যানেলের অন্তর্ভুক্তি শুধুমাত্র একটি বড় মাইলফলক নয়, বরং ক্রিকেটে লিঙ্গ সমতা অগ্রসর করার জন্য আইসিসির অটুট অঙ্গীকারের একটি শক্তিশালী প্রতিফলনও”।
তিনি আরও যোগ করেন, “এই উন্নয়ন শুধু প্রতীকী মূল্যের চেয়ে এগিয়ে যায়। এটি দৃশ্যমানতা, সুযোগ এবং অর্থবহ রোল মডেল সৃষ্টির বিষয়ে যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। বিশ্বমঞ্চে অফিশিয়েটিংয়ে শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে, আমরা আকাঙ্ক্ষা জাগানো এবং ক্রিকেটে নেতৃত্ব ও প্রভাব কোনো লিঙ্গ জানে না তা পুনর্নিশ্চিত করার লক্ষ্য রাখি”।
ক্রিকেটে মহিলা আম্পায়ারদের উত্থান একটি বিপ্লবী পরিবর্তন এনেছে। দশকের পর দশক ধরে পুরুষ-আধিপত্যের ক্ষেত্রে মহিলারা বাধা ভেঙে এগিয়ে এসেছেন। অস্ট্রেলিয়ার ক্লেয়ার পলোস্যাক এই ক্ষেত্রে অগ্রদূত হিসেবে ইতিহাস তৈরি করেছেন। ২০১৭ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার পুরুষদের গার্হস্থ্য ম্যাচে দায়িত্ব পালনকারী প্রথম মহিলা আম্পায়ার হন। ২০১৯ সালে তিনি পুরুষদের একদিনের আন্তর্জাতিকে দায়িত্ব পালনকারী প্রথম মহিলা আম্পায়ার হিসেবে ইতিহাস রচনা করেন। এমনকি ২০২১ সালে তিনি পুরুষদের টেস্ট ম্যাচে চতুর্থ আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী প্রথম মহিলা হন।
ইংল্যান্ডের সু রেডফার্ন আরেকজন অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব। প্রাক্তন ইংল্যান্ড ক্রিকেটার সু রেডফার্ন ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন এবং বর্তমানে ক্রিকেট আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২২ সালে তিনি ইংল্যান্ডের প্রফেশনাল আম্পায়ার টিমে অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রথম মহিলা আম্পায়ার হন। ২০২৩ সালে তিনি ইংল্যান্ডে পুরুষদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ম্যাচে দায়িত্ব পালনকারী প্রথম মহিলা আম্পায়ার হন। তার ক্যারিয়ারে ৮০টি ক্রিকেট ম্যাচে দায়িত্ব পালনের রেকর্ড রয়েছে, যার মধ্যে ৪৪টি মহিলাদের টি-টোয়েন্টি, ২৫টি মহিলাদের একদিনের আন্তর্জাতিক এবং তিনটি মহিলাদের টেস্ট ম্যাচ অন্তর্ভুক্ত।
এই বিশ্বকাপ আয়োজনের ক্ষেত্রেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। মূলত বেঙ্গালুরুর এম. চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী ম্যাচ ও ফাইনাল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও স্টেডিয়ামটি অনুপলব্ধ হওয়ায় নবী মুম্বাইয়ের ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়াম প্রতিস্থাপিত হয়েছে। গুয়াহাটির এসিএ স্টেডিয়ামে ৩০ সেপ্টেম্বর ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে উদ্বোধনী ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে, আর ফাইনাল হবে ২ নভেম্বর নবী মুম্বাই বা কলম্বোয়। যদি পাকিস্তান ফাইনালে পৌঁছায়, তাহলে ম্যাচটি কলম্বোয়ে অনুষ্ঠিত হবে।
প্রতিযোগিতায় আটটি দল অংশগ্রহণ করবে – ভারত, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা। সাতবারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া তাদের খেতাব রক্ষার জন্য ১ অক্টোবর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রচারাভিযান শুরু করবে। অত্যন্ত প্রত্যাশিত ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে ৫ অক্টোবর কলম্বোয়।
মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে এই সম্পূর্ণ মহিলা অফিশিয়াল প্যানেল নিয়োগ নারী ক্রিকেটের জন্য একটি মাইলফলক ঘটনা। এটি প্রমাণ করে যে ক্রিকেট জগতে নারীরা খেলোয়াড় হিসেবে যেমন এগিয়ে এসেছেন, তেমনি অফিশিয়েটিংয়ের ক্ষেত্রেও তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণিত। এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে আরও নারীদের ক্রিকেটের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করবে এবং খেলায় লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আইসিসি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ক্রিকেটে নেতৃত্ব ও প্রভাব কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গের একচেটিয়া বিষয় নয়। ২০২৫ সালের মহিলাদের বিশ্বকাপ হয়ে উঠবে শুধু ক্রিকেট প্রতিযোগিতা নয়, বরং নারী ক্ষমতায়ন ও সমতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এই প্রতিযোগিতা বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।