দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংক ICICI Bank তাদের নতুন সেভিংস অ্যাকাউন্টের জন্য ন্যূনতম গড় জমার পরিমাণ ৫ গুণ বৃদ্ধি করেছে। ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে কার্যকর এই নতুন নিয়ম অনুযায়ী, শহরাঞ্চল ও মহানগরীতে নতুন সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলতে ন্যূনতম ৫০,০০০ টাকা গড় মাসিক ব্যালেন্স রাখতে হবে, যা আগে ছিল মাত্র ১০,০০০ টাকা। এই পরিবর্তন শুধুমাত্র নতুন গ্রাহকদের উপর প্রযোজ্য হবে এবং বিদ্যমান অ্যাকাউন্টধারীদের কোনো প্রভাব পড়বে না।
ব্যাংকটির এই সিদ্ধান্তে সামাজিক মাধ্যমে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকেই এই পদক্ষেপকে ‘অভিজাত শ্রেণীর পক্ষপাতী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং দাবি করেছেন যে এটি সাধারণ মানুষকে মৌলিক ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত করবে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হলো উচ্চ আয়ের গ্রাহকদের প্রতি ফোকাস করা এবং পরিচালনা খরচ কমানো।
নতুন নিয়মে শুধু শহরাঞ্চল নয়, উপশহর এবং গ্রামাঞ্চলের গ্রাহকরাও প্রভাবিত হবেন। উপশহরাঞ্চলে নতুন সেভিংস অ্যাকাউন্টের জন্য ন্যূনতম গড় মাসিক ব্যালেন্স ৫,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫,০০০ টাকা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এই পরিমাণ ২,৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ১০,০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বৃদ্ধি গ্রামীণ অঞ্চলে চার গুণ এবং অন্যান্য এলাকায় পাঁচ গুণ।
ব্যাংকিং খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ICICI Bank-এর এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ব্যতিক্রমী। স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া সহ বেশিরভাগ সরকারি ব্যাংক ইতোমধ্যে ন্যূনতম ব্যালেন্সের জরিমানা তুলে নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ICICI Bank-এর এই পদক্ষেপ বাজারে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
গ্রাহকদের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্ধারিত ন্যূনতম ব্যালেন্স বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে জরিমানা। ব্যাংকটি ঘাটতির ৬% বা ৫০০ টাকা – যেটি কম, সেটি জরিমানা হিসেবে কেটে নেবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে ৪০,০০০ টাকা থাকে (৫০,০০০ টাকার প্রয়োজনীয় ব্যালেন্স থেকে ১০,০০০ টাকা কম), তাহলে তাকে ৫০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে, যেহেতু ১০,০০০ টাকার ৬% (৬০০ টাকা) ৫০০ টাকার চেয়ে বেশি।
ক্যাশ লেনদেনের ক্ষেত্রেও নতুন চার্জ আরোপ করেছে ব্যাংকটি। মাসে তিনটি বিনামূল্যে ক্যাশ লেনদেনের পর প্রতিটি লেনদেনের জন্য ১৫০ টাকা চার্জ প্রযোজ্য হবে। একইভাবে মাসিক ১ লাখ টাকার বেশি লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতি হাজার টাকায় ৩.৫০ টাকা বা ১৫০ টাকা – যেটি বেশি, সেটি চার্জ হিসেবে কাটা হবে।
তৃতীয় পক্ষের ক্যাশ জমা ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে প্রতি লেনদেনে সর্বোচ্চ ২৫,০০০ টাকার সীমা বেঁধে দিয়েছে ব্যাংক। অকার্যকর সময়ে (বিকেল ৪:৩০ থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত এবং ছুটির দিনে) ক্যাশ রিসাইক্লার মেশিনে জমার জন্য অতিরিক্ত ৫০ টাকা চার্জ দিতে হবে, যদি মাসিক জমার পরিমাণ ১০,০০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
সামাজিক মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনেক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন যে, ভারতের ৯০% মানুষের মাসিক আয় ২৫,০০০ টাকার কম, এমতাবস্থায় ৫০,০০০ টাকা ব্যালেন্স রাখার শর্ত অবাস্তব। কেউ কেউ রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার (RBI) হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন।
ব্যাংকিং বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ICICI Bank-এর এই পদক্ষেপ তাদের কাস্টমার বেইস ফিল্টার করার একটি কৌশল। উচ্চ মূল্যের গ্রাহকদের প্রতি মনোনিবেশ করে তারা তাদের কারেন্ট অ্যান্ড সেভিংস অ্যাকাউন্ট (CASA) অনুপাত বৃদ্ধি করতে চাচ্ছে। এতে তাদের পরিচালনা খরচ কমবে এবং লাভজনকতা বৃদ্ধি পাবে।
তবে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী জনধন অ্যাকাউন্ট এবং বেসিক সেভিংস ব্যাংক ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট (BSBDA) ন্যূনতম ব্যালেন্সের শর্ত থেকে অব্যাহতি পাবে। এই ধরনের অ্যাকাউন্টগুলো বিশেষভাবে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য তৈরি এবং এখানে কোনো ন্যূনতম ব্যালেন্স রাখার প্রয়োজন নেই।
ICICI Bank-এর বর্তমান CEO সন্দীপ বক্সী ২০১৮ সাল থেকে ব্যাংকটি পরিচালনা করছেন। তার নেতৃত্বে ব্যাংকটি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, পণ্য উদ্ভাবন এবং ডিজিটাল পরিসেবা সম্প্রসারণে গুরুত্ব দিয়েছে। সাধারণত ব্যাংকটি নিম্ন প্রোফাইল বজায় রাখে, তাই এই আকস্মিক পরিবর্তন অনেকের কাছেই বিস্ময়কর।
গত দশকে ICICI Bank তাদের ন্যূনতম ব্যালেন্সের পরিমাণ বৃদ্ধি করেনি। এই সময়ে দেশে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই যুক্তি দিয়ে তাদের সিদ্ধান্তকে ন্যায্যতা দিতে পারে, তবে সমালোচকরা বলছেন যে আয় বৃদ্ধি এবং ব্যাংক ব্যালেন্স বৃদ্ধির হার সমানুপাতিক নয়।
এই নতুন নিয়মে বেতনভুক্ত অ্যাকাউন্ট এবং অন্যান্য বিশেষ ক্যাটেগরির অ্যাকাউন্ট প্রভাবিত হবে না বলে সূত্রগুলি জানিয়েছে। কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত স্যালারি অ্যাকাউন্টগুলোতে এই নতুন ন্যূনতম ব্যালেন্সের শর্ত প্রযোজ্য হবে না।
আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং প্রবণতার দিকে তাকালে দেখা যায়, বহুজাতিক ব্যাংকগুলো সাধারণত উচ্চ ন্যূনতম ব্যালেন্স রাখে কারণ তাদের শাখা সংখ্যা সীমিত এবং গ্রাহক সেবার খরচ বেশি। কিন্তু ICICI Bank-এর মতো একটি দেশীয় বড় ব্যাংকের জন্য এই ধরনের পদক্ষেপ অস্বাভাবিক।
মাসিক গড় ব্যালেন্স (MAB) হিসাব করার নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিদিনের শেষ ব্যালেন্স যোগ করে মাসের মোট দিন দিয়ে ভাগ দিলে যে পরিমাণ পাওয়া যায়, সেটিই মাসিক গড় ব্যালেন্স। অর্থাৎ, প্রতিদিন ৫০,০০০ টাকা থাকতে হবে এমন নয়, বরং মাসের গড় হিসাবে এই পরিমাণ থাকতে হবে।
ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ ICICI Bank-এর মার্জিন বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। কম খরচে আরও বেশি আমানত সংগ্রহ করতে পারবে ব্যাংকটি। তবে এতে করে গ্রাহক সংখ্যা কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সরকারি ব্যাংকগুলো যখন জনবান্ধব নীতি গ্রহণ করছে, ঠিক তখনই ICICI Bank-এর এই সিদ্ধান্ত তাদের ব্র্যান্ড ইমেজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক গ্রাহক ইতোমধ্যেই তাদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার কথা ভাবছেন বলে সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছেন।
নতুন এই নিয়মের ফলে ব্যাংকিং খাতে একটি নতুন ট্রেন্ড সৃষ্টি হতে পারে। অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংকও ICICI Bank-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে, যা সামগ্রিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য ব্যাংকিং সেবা আরও ব্যয়বহুল করে তুলবে। ফলে মানুষ হয়তো ডিজিটাল ব্যাংকিং এবং ফিনটেক কোম্পানিগুলোর দিকে আরও বেশি ঝুঁকবে।