ভারতের প্রাণীবিজ্ঞানীরা গত এক বছরে একটি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। দেশজুড়ে গবেষণার মাধ্যমে তারা মোট ৬৮৩টি প্রজাতির প্রাণীর সন্ধান পেয়েছেন, যার মধ্যে ৪৫৯টি প্রজাতি বিজ্ঞানের কাছে সম্পূর্ণ নতুন এবং ২২টি প্রজাতি ভারতে প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত হয়েছে1। এই উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
জুলাইয়ের প্রথম দিনে কলকাতার বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে এশিয়ার প্রাচীনতম প্রাণী সর্বেক্ষণ বিভাগ জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ZSI) এর ১১০তম প্রতিষ্ঠা দিবসে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়1। কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব এই বিশেষ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন এবং ২০২৪ সালের গবেষণার ফলাফল ঘোষণা করেন।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী কেরালা এই তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে আছে। দক্ষিণ ভারতের এই রাজ্য থেকে ৮০টি নতুন প্রজাতির প্রাণীর সন্ধান মিলেছে, যা সর্বোচ্চ সংখ্যা1। তবে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থানও অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক, কারণ এখান থেকে ২৫টি সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির প্রাণীর খোঁজ পাওয়া গেছে যার কোনো রেকর্ড আগে প্রাণীবিজ্ঞানে ছিল না। এছাড়াও বাংলায় এমন ৩১টি প্রজাতির প্রাণী পাওয়া গেছে যাদের এর আগে কখনও বাংলার মাটিতে দেখা যায়নি।
ZSI-এর অধিকর্তা ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায় এই অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি জানান যে সংস্থা প্রথম থেকেই ফিল্ড ওয়ার্কের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে1। তার মতে, পৃথিবীর স্থলভাগের মাত্র ২.৪ শতাংশ জায়গা নিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ড গঠিত, তবুও পৃথিবীর মোট প্রাণী প্রজাতির ৮.৪ শতাংশই ভারতে পাওয়া যায়। এই সংখ্যা প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২ সালের শেষে ভারতে মোট ১ লক্ষ ৫ হাজার ২৪৪টি প্রজাতির প্রাণীর রেকর্ড রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক প্রাণী প্রজাতির উপস্থিতি ভারতের জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধতা প্রমাণ করে। প্রাণীবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে যথাযথ অনুসন্ধান হলে পশ্চিমবঙ্গও জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
শুধুমাত্র প্রাণী নয়, উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ২০২ সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (BSI) গত বছর ভারতে ৪১০টি নতুন প্রজাতির উদ্ভিদের খোঁজ পেয়েছে। এর মধ্যে ২৪৫টি প্রজাতি সম্পূর্ণ নতুন আবিষ্কার এবং ১৮৮টি প্রজাতি প্রথমবারের মতো ভারতে পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখলে, দেশটিতে প্রায় ১৬০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী এবং প্রায় ১০০০ প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণী রয়েছে। মেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে ২২ প্রজাতির উভচর, ৭০৮ প্রজাতির মাছ, ১২৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬২৮ প্রজাতির পাখি এবং ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। বাংলাদেশেও নিয়মিত নতুন প্রাণী প্রজাতির সন্ধান মিলছে, যেমন মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ১১টি নতুন প্রজাতির প্রাণী পাওয়া গেছে।
ভৌগোলিক অবস্থান এবং পরিবেশগত বৈচিত্র্যের কারণে ভারতীয় উপমহাদেশ জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দীর্ঘ সমুদ্র উপকূল, অসংখ্য নদী ও তাদের শাখা-প্রশাখা, হ্রদ, হাওর, বাওড়, পুকুর এবং জলাভূমির উপস্থিতি বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর জন্য আদর্শ আবাসস্থল তৈরি করেছে। নিম্নভূমির গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রকৃতি, চিরহরিৎ বন, পাহাড়ি বন, আর্দ্র পর্ণমোচী অরণ্য এবং লম্বা ঘাসের সমতলভূমি এই অঞ্চলে পাওয়া বিভিন্ন প্রজাতির বৈচিত্র্য নিশ্চিত করেছে।
তবে পরিবেশবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে অতিরিক্ত জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং কৃষি ও শিল্পের অনিয়ন্ত্রিত প্রসারণ এই অঞ্চলের পরিবেশগত কাঠামোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলস্বরূপ বেশ কয়েকটি প্রজাতি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং আরও অনেক প্রজাতি বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন কারণ প্রতিটি নতুন প্রজাতির আবিষ্কার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই গবেষণার ফলাফল ভবিষ্যতে সংরক্ষণ নীতি প্রণয়নে সহায়ক হবে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
এই আবিষ্কারের মাধ্যমে ভারত বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য গবেষণায় তার শক্তিশালী অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলোর অবদান প্রমাণ করে যে দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই অনাবিষ্কৃত প্রাণী প্রজাতির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। ভবিষ্যতে আরও গভীর গবেষণার মাধ্যমে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী।