বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সোমবার নিউইয়র্কে স্বীকার করেছেন যে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি “অত্যন্ত জটিল বাণিজ্য আলোচনা” চলমান রয়েছে এবং তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এই আলোচনা একটি সফল পরিণতিতে পৌঁছাবে। ট্রাম্প প্রশাসনের জুলাই ৯ তারিখের শুল্ক আরোপের চূড়ান্ত সময়সীমার আগে উভয় দেশ একটি অন্তর্বর্তীকালীন বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করার জন্য তীব্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে নিউজউইকের সিইও দেব প্রগাদের সাথে কথোপকথনের সময় জয়শঙ্কর বলেছেন, “আমাদের আশা হলো এটি একটি সফল উপসংহারে নিয়ে যাওয়া। তবে আমি এর গ্যারান্টি দিতে পারি না, কারণ এখানে আরেকটি পক্ষ জড়িত।” তিনি আরো বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের যেমন ভারত সম্পর্কে মতামত রয়েছে, তেমনি ভারতের মানুষেরও আমেরিকা সম্পর্কে মতামত রয়েছে। আমাদের একটি মিলনক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে।”
বাণিজ্য আলোচনার বর্তমান পর্যায়ে ভারতীয় প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটনে তাদের অবস্থান বাড়িয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সচিব এবং প্রধান আলোচক রাজেশ আগ্রওয়ালের নেতৃত্বে দলটি জুন ২৭ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছিল এবং প্রাথমিকভাবে দুই দিনের জন্য থাকার কথা থাকলেও চলমান মতবিরোধের কারণে তাদের অবস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে। সূত্রমতে, ভারতীয় দল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত একটি চুক্তি সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে।
কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন চাহিদা মেটানোর বিষয়ে ভারত তার শক্ত অবস্থান বজায় রেখেছে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ সম্প্রতি ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে বলেছেন যে কৃষি ও দুগ্ধ খাত ভারতের জন্য “বড় লাল রেখা”। তিনি উল্লেখ করেছেন যে এই খাতগুলিতে ভারত অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিয়েছে, কারণ ভারতীয় কৃষকরা ছোট ছোট জমিতে জীবিকা নির্বাহী চাষাবাদ করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছে শিল্পপণ্য, অটোমোবাইল (বিশেষ করে বৈদ্যুতিক গাড়ি), ওয়াইন, পেট্রোকেমিক্যাল পণ্য, দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং কৃষিপণ্যের ওপর শুল্ক ছাড় চাইছে। বিশেষভাবে আমেরিকা জিএম ফসল, গবাদি পশুর খাদ্য এবং বিভিন্ন দুগ্ধজাত ও কৃষিপণ্যের জন্য ভারতীয় বাজারে বৃহত্তর প্রবেশাধিকার চাইছে। তবে এই বিষয়গুলি ভারতের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল, কারণ এগুলি সরাসরি ভারতীয় কৃষকদের স্বার্থের সাথে জড়িত।
অপরদিকে, ভারত শ্রমনিবিড় খাতগুলির জন্য শুল্ক ছাড় চাইছে। এর মধ্যে রয়েছে বস্ত্র, রত্ন ও গহনা, চামড়াজাত পণ্য, পোশাক, প্লাস্টিক, রাসায়নিক, চিংড়ি, তেলবীজ, আঙুর এবং কলা। ভারত বিশেষভাবে ২৬ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক থেকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি চাইছে, যদিও ১০ শতাংশ বেসলাইন শুল্ক এখনও বহাল রয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন এপ্রিল মাসে ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৬ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করেছিল, যা জুলাই ৯ পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি ফক্স নিউজকে বলেছেন যে তার প্রশাসন আর এই ধরনের ব্যতিক্রম বাড়ানোর সম্ভাবনা কম। তিনি “যা আমরা চাই” উল্লেখ করে শুল্ক প্রয়োগের বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করেছেন।
চুক্তির কাঠামো নিয়ে আলোচনায় দেখা যাচ্ছে যে এটি পর্যায়ক্রমে সম্পন্ন হতে পারে। প্রথম ধাপে একাধিক খাত অন্তর্ভুক্ত হবে এবং অক্টোবর পর্যন্ত আরো বিস্তারিত আলোচনা অব্যাহত থাকবে। এটি একটি বৃহত্তর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির (বিটিএ) অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সূত্রমতে, উভয় পক্ষের মধ্যে ৯০ শতাংশ শুল্ক লাইনে ভারত ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে কৃষি ও দুগ্ধ খাতে মতবিরোধ অব্যাহত রয়েছে। একজন সরকারি সূত্র রয়টার্সকে বলেছেন, “এই খাতগুলি উন্মুক্ত করার বিষয়ে কিছু মতবিরোধ রয়েছে, যদিও ভারত ৯০ শতাংশ শুল্ক লাইনে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেবেন।”
ইন্ডিয়া টুডের রিপোর্ট অনুযায়ী, সব শর্ত সম্মত ও চূড়ান্ত হয়েছে এবং জুলাই ৮ তারিখের আগে চুক্তি ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে। এই চুক্তি শুধুমাত্র শুল্ক বৃদ্ধি এড়াতেই নয়, বরং বিশ্বের দুই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃনির্ধারণ করতে এবং আরো বিস্তৃত অর্থনৈতিক সহযোগিতার রোডম্যাপ প্রদান করতে সাহায্য করবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই শিল্প স্টেকহোল্ডারদের জানিয়ে দিয়েছেন যে চুক্তির প্রাথমিক পর্যায় সম্পন্ন হওয়ার কাছাকাছি এবং পরবর্তী আলোচনা অব্যাহত থাকবে। যদি ঘোষণা করা হয়, তাহলে এই অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি কেবল শুল্ক বৃদ্ধি রোধ করবে না, বরং দুই দেশের মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে বাণিজ্য দ্বিগুণ করে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।