India oil import diversification: মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যেও ভারত তার কৌশলগত অবস্থান কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে চলেছে। ইজরায়েল-ইরান সংঘাতের মধ্যে ভারত জুন মাসে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল আমদানি বৃদ্ধি করেছে, যা দেশের শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। একই সাথে ইজরায়েলের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অব্যাহত রেখে ভারত কোটি কোটি টাকার ব্যবসায়িক সুবিধা নিশ্চিত করেছে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় স্টক মার্কেট ইজরায়েল-ইরান উত্তেজনা সত্ত্বেও সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ১.৬ শতাংশ লাভ করেছে। নিফটি সূচক ৩১৯.১৫ পয়েন্ট বা ১.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৫,১১২.৪০ পয়েন্টে পৌঁছেছে। বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের কৌশলগত তেল আমদানি নীতি এবং প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ এই লাভজনক অবস্থানের পেছনে মূল কারণ।
তেল আমদানিতে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে ভারত উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। জুন মাসে দেশটি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বৃদ্ধি করেছে, যা সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের সরবরাহকারীদের সম্মিলিত পরিমাণের চেয়েও বেশি। রাশিয়ান তেল (ইউরাল, ইএসপিও, সোকোল) হরমুজ প্রণালী ব্যবহার করে না, বরং সুয়েজ খাল, কেপ অব গুড হোপ বা প্রশান্ত মহাসাগরের মাধ্যমে পরিবহন হয়। এই কৌশলগত সিদ্ধান্ত ভারতকে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে সুরক্ষা দিয়েছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে ইজরায়েলের সাথে গভীর সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে, যা বার্ষিক কোটি কোটি টাকার ব্যবসার সুযোগ তৈরি করেছে। ভারত ইজরায়েল থেকে বারাক ৮ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, লোইটারিং মিউনিশন এবং উচ্চ প্রযুক্তির রাডার সিস্টেম কিনেছে। গত মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সময় নয়াদিল্লি বিভিন্ন ইজরায়েলি তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করেছে, যা এই কৌশলগত প্রতিরক্ষা জোটের গুরুত্ব তুলে ধরে।
বাণিজ্যিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ সালে ভারত-ইরান বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১.৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে ১.২৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি এবং ৪৪১.৯ মিলিয়ন ডলার আমদানি। অন্যদিকে ইজরায়েলের সাথে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩.৭৬ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ২.১৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি এবং ১.৬১ বিলিয়ন ডলার আমদানি। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে ভারত উভয় দেশের সাথেই লাভজনক বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভারতের বাসমতি চাল রপ্তানি, যা ইরানের সাথে সংঘাতের মধ্যেও অব্যাহত রয়েছে। ২০২৪-২৫ সালে ইরান ভারত থেকে ৮.৫৫ লাখ মেট্রিক টন বাসমতি চাল কিনেছে, যার মূল্য প্রায় ৬,৩৭৪ কোটি টাকা। শক্তিশালী বাণিজ্যিক বছরগুলোতে ইরান ভারতের বাসমতি রপ্তানির ৩০-৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কিনে থাকে। যদিও বর্তমান সংঘাতের কারণে ইরানি ক্রেতারা ১৮০ দিনের বেশি সময় ধরে পেমেন্ট বিলম্বিত করছে, তবুও এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়নি।
ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে ভারত একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। দেশটি ইজরায়েলের সাথে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে দৃঢ় অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করেছে, একই সাথে ইরানের সাথে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, আঞ্চলিক সংযোগ এবং শক্তি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্ব বজায় রেখেছে। এই দ্বিমুখী নীতি ভারতকে উভয় পক্ষের সাথে ব্যবসায়িক সুবিধা নিতে সাহায্য করেছে।
প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ক্ষেত্রেও ভারত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। ইজরায়েলের সাথে বাণিজ্যিক সহযোগিতা নাটকীয়ভাবে বিস্তৃত হয়েছে, যা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনগুলো পূরণ করে। ভারত ইজরায়েল থেকে সেমিকন্ডাক্টর চিপ আমদানি করে এবং জল সাশ্রয়ী কৃষি প্রযুক্তিতে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা করে। ভারতীয় কর্পোরেট দৈত্য গৌতম আদানির আদানি গ্রুপ ইজরায়েলের হাইফা বন্দর পরিচালনা করে।
শক্তি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের কৌশল বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। দেশটি তার আমদানি কৌশল গত দুই বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত করেছে। ভারতীয় শোধনাগারগুলো শোধন এবং পেমেন্টের নমনীয়তা তৈরি করেছে, একই সাথে একটি বিস্তৃত অশোধিত তেলের তালিকার জন্য রান অপ্টিমাইজ করেছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার প্রবাহগুলো যদিও ব্যয়বহুল, তবুও ক্রমবর্ধমানভাবে কার্যকর ব্যাকআপ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের জুনের রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি এই স্থিতিস্থাপকতা-ভিত্তিক মিশ্রণ নিশ্চিত করে। যদি সংঘাত আরও গভীর হয় বা হরমুজে কোনো স্বল্পমেয়াদী বিঘ্ন ঘটে, তাহলে রাশিয়ান ব্যারেল শেয়ারে বৃদ্ধি পাবে, যা শারীরিক প্রাপ্যতা এবং মূল্য স্বস্তি উভয়ই প্রদান করবে। এই কৌশলগত অবস্থান ভারতকে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা থেকে রক্ষা করে একই সাথে অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে সাহায্য করছে।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, ইজরায়েল-ইরান সংঘাতের মধ্যেও ভারত তার বহুমুখী কূটনীতি ও কৌশলগত অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য আর্থিক সুবিধা অর্জন করে চলেছে। তেল আমদানি বৈচিত্র্যকরণ, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অব্যাহত রাখা এবং উভয় পক্ষের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে ভারত এই জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে।