রাজারহাটের নিউ টাউন অ্যাকশন এরিয়া-থ্রিতে আইটিসি ইনফোটেকের ১৭ একর জমিতে নির্মিত এআই ও আইটিইএস ক্যাম্পাসের জন্য নিউ টাউন কলকাতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনকেডিএ) অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট জারি করেছে। মঙ্গলবার নিজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই সুখবর জানান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।রাজ্যের প্রথম এই এআই হাব থেকে পাঁচ হাজারেরও বেশি পেশাদার কর্মীর কর্মসংস্থান হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এই যুগান্তকারী প্রকল্পটি হিডকোর বরাদ্দকৃত জমিতে প্রায় ১,২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে নির্মিত হয়েছে।মোট ১৪.৫ লক্ষ বর্গফুটেরও বেশি আয়তনে গড়ে ওঠা এই ক্যাম্পাসে তিনটি প্রধান ভবন রয়েছে – একটি আকাশচুম্বী অফিস টাওয়ার, একটি ব্যবসায়িক সহায়তা কেন্দ্র এবং একটি নলেজ ক্যাম্পাস। অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট প্রাপতির মাধ্যমে এই ক্যাম্পাস এখন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরুর জন্য প্রস্তুত।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, “এই ক্যাম্পাসটি হিডকোর বরাদ্দকৃত ১৭ একর জমিতে নির্মিত। এটি বাংলার জন্য একটি মাইলফলক।” তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে এখন থেকে এটি দেশের এবং বিশ্বের ডিজিটাল ও প্রযুক্তিনির্ভর বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান গন্তব্যস্থল হবে এবং পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে এর প্রভাব ব্যাপক হবে।
এই প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারি মাসে। বিশ্ব বাংলা বাণিজ্য সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের প্রথম ‘গ্লোবাল সেন্টার অফ এক্সেলেন্স ফর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ উদ্বোধন করেন।রাজারহাটে গড়ে ওঠা এআই হাবটি ৪০টিরও বেশি দেশের ক্লায়েন্টদের সেবা দেবে, যা রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে।
আইটিসি লিমিটেডের চেয়ারম্যান সঞ্জীব পুরী ২০২৫ সালের বিশ্ব বাংলা বাণিজ্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন যে তাঁদের অধিকাংশ বিনিয়োগ পশ্চিমবঙ্গে হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে এখানে ‘অপারেশন কস্ট’ কম, পরিবেশ অনুকূল এবং প্রশাসনিক সহায়তা যথেষ্ট পাওয়া যায়।
কলকাতাকে গ্লোবাল এআই হাবের জন্য বেছে নেওয়ার পেছনে বেশ কিছু কৌশলগত কারণ রয়েছে। সঞ্জীব পুরীর মতে, কলকাতার ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত ভালো এবং আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের তরফে যাবতীয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে মেধা ও প্রতিভার অভাব নেই – ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি), ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই), ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের (আইআইএম) মতো প্রথমসারির প্রতিষ্ঠান থেকে দক্ষ কর্মী পাওয়া যাবে।
প্রযুক্তি খাতে আইটিসির উপস্থিতি আরও জোরদার করার লক্ষ্যেই কলকাতায় এআই সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। “এখানে পর্যাপ্ত মেধা রয়েছে। আইআইটি, আইআইএম, আইএসআই-এর মতো উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ক্লায়েন্টদের পরিষেবা দেওয়া হবে এই সেন্টার থেকে,” বলেছেন সঞ্জীব পুরী।
এই এআই হাব প্রকল্পটি কেবল একটি অফিস কমপ্লেক্স নয়, বরং এটি আইটিসি গ্রুপের ডিজিটাল কর্মসূচির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠবে। পুরো বিশ্বের বিভিন্ন ক্লায়েন্টকে পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কলকাতার ‘গ্লোবাল হাব’-কে মধ্যমণি করে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের এআই সমাধান ও সেবা প্রদান করা হবে, যা ভারতের প্রযুক্তি রপ্তানিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
পশ্চিমবঙ্গে আইটিসির সামগ্রিক উপস্থিতিও উল্লেখযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গে আইটিসির ১৮টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট রয়েছে। পর্যাপ্ত জলের জোগান ও মেধাবী কর্মী সমৃদ্ধ পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসার ভবিষ্যৎও উজ্জ্বল বলে মনে করেন সঞ্জীব পুরী। আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গে আইটিসি আরও বিনিয়োগ করবে এবং আগামী এক বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে আইটিসির হোটেল সংখ্যাও দ্বিগুণ করার ঘোষণা করেছেন তিনি।
এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেটের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সার্টিফিকেট হলো স্থানীয় পুরকর্তৃপক্ষের অনুমোদিত একটি নথি, যা নিশ্চিত করে যে ভবনটি নির্মাণের সকল আইন-নিয়ম ও নিরাপত্তা মানদণ্ড পূরণ করে বসবাস বা কাজের জন্য নিরাপদ।এই সার্টিফিকেট প্রাপতির মাধ্যমে ক্যাম্পাসটি এখন পূর্ণ কার্যক্রম শুরুর জন্য আইনগতভাবে প্রস্তুত।
নিউ টাউন কলকাতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এই সার্টিফিকেট প্রদান পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় বহন করে। এটি প্রমাণ করে যে রাজ্য সরকার বড় বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোর অনুমোদন ও বাস্তবায়নে দ্রুততার সাথে কাজ করতে সক্ষম। এই ধরনের সহযোগিতা ভবিষ্যতে আরও বিদেশি ও দেশীয় বিনিয়োগকারীদের রাজ্যে আকৃষ্ট করতে সাহায্য করবে।
রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রেক্ষিতে এই এআই সেন্টারের উদ্বোধন নিশ্চিতভাবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এটি পশ্চিমবঙ্গকে দেশের এআই ও প্রযুক্তি খাতের মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাবে। বিশেষত, যখন সারা বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন এই সময়োপযোগী উদ্যোগ রাজ্যের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক।
নতুন এই প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগকে বাংলা থেকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাঁচ হাজারেরও বেশি পেশাদারের জন্য সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টির এক বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাঁড়াবে এই প্রকল্প, যা রাজ্যের যুব সমাজের কর্মসংস্থান সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।