পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর আগামী চলচ্চিত্র ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তুমুল বিতর্কের মাঝে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা ঋদ্ধি সেন তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। বাংলার ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় তিনি মন্তব্য করেছেন, “বিবেক অগ্নিহোত্রী আসলে বিবেকহীন মূর্খহোত্রী।”
বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গার সময়ের বিখ্যাত চরিত্র গোপাল মুখোপাধ্যায়, যিনি ‘গোপাল পাঁঠা’ নামে পরিচিত ছিলেন। ছবিতে তাঁকে “এক থা কষাই গোপাল পাঁঠা” হিসেবে উপস্থাপনার অভিযোগে গোপাল মুখোপাধ্যায়ের নাতি শান্তনু মুখোপাধ্যায় বউবাজার থানায় এফআইআর দায়ের করেছেন এবং পরিচালককে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন।
স্পষ্টবাদী ঋদ্ধি সেন এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যঙ্গাত্মকভাবে মন্তব্য করেছেন, “আজকে ফেসবুক এবং হোয়াটস্যাপ ইতিহাসবিদদের জন্য একটি দুঃখের দিন।” তিনি আরও যোগ করেছেন, “এই জন্যই কখনও কিছু নিষিদ্ধ করা উচিত না। সত্যি চাপা থাকে না। বরং জনসমক্ষে সেই সত্য উদঘাটন হওয়া প্রয়োজন। ট্রেলারটা মুক্তি না পেলে কেউ জানতেই পারত না যে, বিবেক অগ্নিহোত্রী আসলে বিবেকহীন মূর্খহোত্রী।”
গোপাল মুখোপাধ্যায়ের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে তাঁর নাতি শান্তনু মুখোপাধ্যায় বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। তাঁর মতে, “অনুশীলন সমিতির কাজে যুক্ত থাকার পাশাপাশি দাদু দুটো পাঁঠার মাংসের দোকান চালাতেন। কুস্তিগির ছিলেন, বুকের পাটা ছিল ঈর্ষণীয়। হিন্দিভাষীদের মুখে মুখে সেই বুকের পাটা হয় ‘পাট্টা’। শেষে তাঁর পেশা আর নেশা মিলিয়ে অপভ্রংশে নাম হয়ে যায় গোপাল পাঁঠা।”
১৯৪৬ সালের ছেচল্লিশের দাঙ্গার প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে শান্তনু জানান, “দাদু আমার কষাই চরিত্র ছিলেন না, ভিলেনও ছিলেন না। ছিলেন সিংহহৃদয়। ১৯৪৬-এ মুসলিম লিগের দাঙ্গা প্রতিরোধে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে আতঙ্কিত মানুষের স্বার্থে যিনি অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। বাঁচিয়েছিলেন এই বাংলা ও বাঙালিকে। তাঁর চরিত্রকে বিকৃত করে দেখিয়েছেন বিবেক।”
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’-এ কলকাতায় যে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, সেই পরিস্থিতিতে গোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁর অনুগামীদের সংগঠিত করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল – দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই হবে, কিন্তু নিরীহ মানুষকে আঘাত করা যাবে না।
বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যান্য ব্যক্তিত্বরাও এই বিতর্কে যোগ দিয়েছেন। অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, “তুমি সিনেমা দেখে ইতিহাস শিখছো? তাহলে এবার ইউটিউব থেকে সাঁতার আর রেডিও থেকে পেন্টোমাইম শিখে নাও ভাই।” প্রযোজক রানা সরকার আরও কঠোর ভাষায় বিবেক অগ্নিহোত্রীকে “রাজনৈতিক দলের অ্যাড ফিল্মমেকার” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
প্রতিক্রিয়ায় বিবেক অগ্নিহোত্রী দাবি করেছেন যে তিনি গোপাল পাঁঠাকে নায়ক হিসেবেই দেখিয়েছেন এবং কোনো ইতিহাস বিকৃত করেনি। তবে পরিবারের আপত্তি অব্যাহত রয়েছে কারণ ছবিতে চরিত্রটি ব্যবহারের জন্য তাঁদের কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি।
কলকাতায় ছবির ট্রেলার লঞ্চের সময়ও বিতর্ক দেখা দেয়। পরিচালকের অভিযোগ, রাজনৈতিক চাপে ট্রেলার প্রদর্শনে বাধা দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারি পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে প্রয়োজনীয় অনুমতি ছাড়াই অনুষ্ঠান করার চেষ্টা হয়েছিল।
অভিনেত্রী সঙ্ঘশ্রী সিনহা মিত্র বিবেক অগ্নিহোত্রীর বিরুদ্ধে মুখ খোলার পর প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি বিবেকের “বাংলা দ্বিতীয় কাশ্মীর হতে চলেছে” মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বিতর্কের মাঝে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় বিবেক অগ্নিহোত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পত্র লিখে পশ্চিমবঙ্গে ছবিটির শান্তিপূর্ণ মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। তাঁর মতে, এ ধরনের পদক্ষেপ শিল্পের স্বাধীনতা এবং মানুষের সত্য জানার অধিকার কেড়ে নেয়।
ছবির প্রধান অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় বিতর্ক এড়িয়ে বলেছেন যে তিনি ছবির নাম পরিবর্তনের বিষয়ে অবগত ছিলেন না। অন্যদিকে পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায় বিবেকের পক্ষ নিয়ে বলেছেন যে পাল্টা ন্যারেটিভ তৈরি করাই সমাধান, ছবি নিষিদ্ধ করা নয়।
মিঠুন চক্রবর্তী, অনুপম খের, পল্লবী যোশী, দর্শন কুমার সহ তারকাদের অভিনয়ে নির্মিত ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ আগামী ৫ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গে এর মুক্তি নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
বহু এফআইআর এবং আইনি জটিলতার মুখে বিবেক অগ্নিহোত্রী কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁর দাবি, ছবিটি হিন্দু গণহত্যার ঐতিহাসিক সত্য তুলে ধরে এবং কোনো সাম্প্রদায়িক উস্কানি নেই। তবে সমালোচকদের অভিযোগ, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্যই এই ছবি নির্মিত হয়েছে।
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা ছিল জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফল এবং সেসময় হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই একে অপরকে রক্ষা করার ঘটনা ছিল, যা এ ধরনের একপাক্ষিক উপস্থাপনায় হারিয়ে যায়। গোপাল মুখোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে একটি বিতর্কিত চরিত্র ছিলেন, কিন্তু তাঁকে নিছক ‘কষাই’ হিসেবে চিত্রিত করা ইতিহাসের সরলীকরণ বলে অনেকের মত।
বর্তমানে বাংলার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এই বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। ঋদ্ধি সেনের তীব্র সমালোচনা এই আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যেখানে শিল্পের স্বাধীনতা এবং ইতিহাসের সঠিক উপস্থাপনের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে।