The Bengal Files Movie: দেশের অন্যতম বিতর্কিত চলচ্চিত্র নির্মাতা বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রীর আসন্ন সিনেমা ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে বিরাট ঝড় উঠেছে। ২০২২ সালের ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ চলচ্চিত্রের পর এবার অগ্নিহোত্রী তাক লাগিয়েছেন বাংলার ইতিহাসকে কেন্দ্র করে। কিন্তু কেন এই সিনেমা নিয়ে এত হৈচৈ? প্রশ্ন উঠেছে, এটি কি ইতিহাসের সত্য উপস্থাপন, নাকি ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর রাজনৈতিক হাতিয়ার?
বিতর্কের মধ্যমণি: বাংলার কালো অধ্যায়ের চিত্রায়ণ
ট্রেইলার লঞ্চের গোলযোগ থেকে শুরু
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’-এর ট্রেইলার প্রকাশকেই কেন্দ্র করে শুরু হয় বিতর্ক। ১৬ আগস্ট ২০২৫, যেদিন ১৯৪৬ সালের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালিত হয়েছিল, সেদিন কলকাতায় ট্রেইলার লঞ্চ অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রথমে একটি মাল্টিপ্লেক্স অনুষ্ঠান বাতিল করে, পরে একটি পাঁচতারা হোটেলেও অনুষ্ঠানে বাধা আসে।
অগ্নিহোত্রী অভিযোগ করেন, “কলকাতা পুলিশ আমাদের ট্রেইলার লঞ্চ বন্ধ করে দিয়েছে। এটি একনায়কত্ব, এটি ফ্যাসিবাদ। একটি সিবিএফসি অনুমোদিত সিনেমার ট্রেইলার লঞ্চ বন্ধ করা হয়েছে সামনেই। আমার কণ্ঠস্বর দমানো যাবে না।”
সিনেমার বিষয়বস্তু: হিন্দু গণহত্যার দাবি
১৯৪৬ সালের ভয়াবহ ঘটনার পুনর্নিরীক্ষণ
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ মূলত ১৯৪৬ সালের ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে এবং তার পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এই ঘটনা ইতিহাসে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামেও পরিচিত। মুসলিম লীগের আহ্বানে শুরু হওয়া এই দাঙ্গায় ১৬-১৯ আগস্টের মধ্যে অন্তত ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ মানুষ মারা যান এবং প্রায় ১৫,০০০ মানুষ আহত হন।
অগ্নিহোত্রী দাবি করেছেন, তার সিনেমায় প্রায় ৪০,০০০ মানুষের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে এবং এই সংখ্যা ঐতিহাসিক রেকর্ড থেকে সংগৃহীত। তিনি এই ঘটনাকে ‘বাংলার গণহত্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং দাবি করেছেন যে হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ‘বাংলার কসাই’ বলা হয়ে থাকে।
খাকি ২: পুলিশের ভূমিকায় সৌরভ গাঙ্গুলি, অভিনয়ে নতুন অধ্যায় শুরু?
বিতর্কের বিভিন্ন দিক
ঐতিহাসিক সত্য নাকি বিকৃতি?
সিনেমাটি নিয়ে প্রধান বিতর্কের একটি দিক হলো ঐতিহাসিক তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা। যদিও ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গা একটি প্রামাণিক ঐতিহাসিক ঘটনা, কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ ৫,০০০-১০,০০০ মৃত্যুর পরিসংখ্যানকে সঠিক মনে করেন।
ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়া অনুযায়ী, “মৃত্যুর হার বিতর্কিত রয়ে গেছে, অনুমান ৪,০০০ থেকে ১০,০০০ মানুষের মৃত্যু এবং হাজার হাজার আহত বা বাস্তুচ্যুত হওয়ার মধ্যে”। TIME ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে অনুমানগুলি ৫,০০০ থেকে ২০,০০০ মুসলিম এবং হিন্দু নিহত হওয়ার মধ্যে বিস্তৃত।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিততার অভিযোগ
তৃণমূল কংগ্রেস নেতা কুনাল ঘোষ অগ্নিহোত্রীর বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, “এটি কোনো সিনেমা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক ভিডিও যা নির্বাচনী রাজনৈতিক অ্যাসাইনমেন্টের অংশ হিসেবে তৈরি। বিবেক অগ্নিহোত্রী তার বিবেক বিজেপির কাছে বন্ধক রেখেছেন।”
ঘোষ আরও বলেন, “তাকে ‘গোধরা ফাইলস’, ‘মণিপুর ফাইলস’, ‘উত্তরপ্রদেশ ফাইলস’ তৈরি করতে কী বাধা দিচ্ছে? সে বাংলাকে কালিমালিপ্ত করতে এসেছে।”
সরকারি প্রতিক্রিয়া ও আইনি জটিলতা
একাধিক এফআইআর ও কোর্টের হস্তক্ষেপ
পশ্চিমবঙ্গ সরকার অগ্নিহোত্রী ও তার সিনেমার বিরুদ্ধে একাধিক এফআইআর দায়ের করেছে। অগ্নিহোত্রী জানিয়েছেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিভিন্ন শহরে আমাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য এফআইআর দায়ের করেছে। তাদের কৌশল হচ্ছে আমাদের আইনি ঝামেলায় ফেলে দেওয়া যাতে আমরা সিনেমার উপর মনোযোগ দিতে না পারি।”
তবে কলকাতা হাইকোর্ট এই এফআইআরগুলির উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিয়েছে। অগ্নিহোত্রী বলেন, “মাননীয় হাইকোর্ট সেগুলি স্থগিত রেখেছে। তারা কেন আমাদের চুপ করে রাখতে চায়? সত্যের এতটা ভয় কেন?”
সিনেমার প্রভাব ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনার আশঙ্কা
সিনেমাটি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে এটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর পর, যা ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল এবং কোনো কোনো স্থানে উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
অগ্নিহোত্রী এই আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, “সিনেমাটি ইতিমধ্যেই সেন্সর বোর্ডের অনুমোদন পেয়েছে। এটি আমেরিকার ১২টি শহরে প্রদর্শিত হয়েছে। কেউ ভাবতে পারে এটি অশান্তি সৃষ্টি করবে, কিন্তু আমি বলব এটি সত্য।”
দর্শক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
সিনেমাটি দেখার পর অনেকে বলেছেন যে এটি কেবল চিত্তবিনোদন নয়, বরং ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায়ের সাক্ষ্য। একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “নিউ জার্সিতে প্রথম মার্কিন প্রি-স্ক্রিনিংয়ে হলটি ভর্তি ছিল, কিন্তু চূড়ান্ত দৃশ্যগুলি উন্মোচিত হওয়ার সাথে সাথে নীরবতায় ভারী হয়ে উঠেছিল।”
অন্যদিকে, অগ্নিহোত্রী বলেছেন, “এটি চিত্তবিনোদন নয়। এটি আপনাকে ভূতের মতো তাড়া করবে। এটি সভ্যতার প্রতিরোধের একটি কাজ।”
আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত ও প্রভাব
বিদেশে প্রদর্শনী ও প্রতিক্রিয়া
মজার ব্যাপার হলো, ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ প্রথমে আমেরিকার ১০টি বড় শহরে প্রদর্শিত হয়েছে, তারপর ভারতে মুক্তি পাওয়ার কথা। এই কৌশলের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রবাসী ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা, বিশেষ করে যুব প্রজন্মের মধ্যে যারা তাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত নন।
একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “হিন্দু যুবসমাজ যেন তাদের ইহুদি সমকক্ষদের মতো তিক্ততায় নয়, সচেতনতায় বেড়ে উঠে। যাতে তারা ইতিহাসকে বোঝা হিসেবে নয়, ঢাল হিসেবে বহন করে।”
সিনেমার শিল্পগত মান ও অভিনয়
তারকা শিল্পীদের অংশগ্রহণ
সিনেমায় রয়েছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী পল্লবী জোশি, কিংবদন্তি অভিনেতা মিথুন চক্রবর্তী, অনুপম খের, দর্শন কুমার ও শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়সহ আরও অনেকে। মিথুন চক্রবর্তী বলেছেন, “‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ হলো সবকিছু যা দর্শকরা কখনো প্রত্যাশা করেনি। আমার জন্য এটিই সিনেমার উদ্দেশ্য – পরিবর্তন আনা এবং মানুষ যা দেখতে চায় তা দেখানো।”
অভিনেত্রী পল্লবী জোশি প্রতিবাদ করে বলেছেন, “আমি একেবারে পছন্দ করিনি যেভাবে আমার সিনেমা বন্ধ করা হয়েছে। এই রাজ্যে কি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে? চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং অভিনেতা হিসেবে আমরা যা তৈরি করেছি তা প্রদর্শন করতে পারছি না।”
বিতর্কের রাজনৈতিক মাত্রা
বিজেপি-তৃণমূলের লড়াই
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে বিতর্ক রাজনৈতিক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিজেপি নেতা সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, “কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ভূমিতে পশ্চিমবঙ্গ আবারও একটি লজ্জাজনক ঘটনার সাক্ষী হলো যা গণতান্ত্রিক শালীনতার সমস্ত সীমা ভেঙে দিয়েছে। যা ঘটেছে তার নিন্দা করার জন্য শব্দ অপর্যাপ্ত।”
অন্যদিকে, তৃণমূলের মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্য বলেছেন, “আগে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ মুক্তি পেয়েছিল এবং বিজেপি সেখানে বিধানসভা নির্বাচনে হেরেছিল। এখন তারা ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে একই চেষ্টা করছে। রাজ্যের মানুষ এই ধরনের চলচ্চিত্রে আগ্রহী নয়। তারা ভালো করেই জানে এবং সেজন্যই তারা মিডিয়ার নজর পেতে হাঙ্গামা করছে।”
সমালোচনা ও প্রশংসার মিশ্রণ
বিভিন্ন মহলের দৃষ্টিভঙ্গি
সিনেমাটি নিয়ে মতামত বিভক্ত। যারা সমর্থন করছেন, তারা বলছেন এটি ইতিহাসের একটি চাপা দেওয়া অধ্যায়ের আলোকপাত করছে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “স্বাধীন ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল যা উদ্দেশ্যে মহৎ হলেও প্রায়ই হিন্দু দুর্ভোগকে রাজনৈতিকভাবে অস্বস্তিকর করে তুলেছিল।”
অন্যদিকে সমালোচকরা বলছেন, এটি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার। তৃণমূল নেতা অরুপ চক্রবর্তী বলেছেন, “মানুষ তার সিনেমা দেখেই না, তাই সে প্রচারের জন্য এই ধরনের স্টান্ট করে। ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর আগেও একই কাজ করেছিল। এটি একটি প্যাটার্ন।”
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, একটি বিষয় স্পষ্ট যে এই সিনেমা ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায়কে সামনে এনেছে। ১৯৪৬ সালের ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে এবং তার পরবর্তী দাঙ্গা নিঃসন্দেহে ভারতীয় ইতিহাসের একটি ভয়াবহ ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, সিনেমার মাধ্যমে এই ইতিহাসের উপস্থাপনা কতটুকু নিরপেক্ষ এবং কতটুকু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।বিবেক অগ্নিহোত্রী যেমন বলেছেন, “স্মৃতিই হলো বেঁচে থাকা”। তবে সেই স্মৃতি যেন বিভাজনের নয়, ঐক্যের হাতিয়ার হয়ে উঠে সেটাই প্রত্যাশা। ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ এর মুক্তি ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, তখনই স্পষ্ট হবে এটি ইতিহাসের সত্য উদ্ঘাটন নাকি রাজনৈতিক এজেন্ডার প্রচার।