বাংলা নাট্যজগতের অন্যতম কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্র আর নেই। ৮৬ বছর বয়সে মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর, ২০২৪) সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে কলকাতার একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়সজনিত নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। গত ৩ নভেম্বর থেকে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এবং ক্রমাগত তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল।
মনোজ মিত্র ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি নাট্যকার, অভিনেতা, পরিচালক এবং শিক্ষক হিসেবে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তাঁর জন্ম ১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলার সাতক্ষীরায়। দেশভাগের পর ১২ বছর বয়সে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন।
নতুন দিগন্তের সন্ধানে: শেক্সপিয়রের ওথেলো থেকে বাংলা সিনেমা ‘অথৈ’
মনোজ মিত্র তাঁর নাটকগুলোতে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে হাস্যরসাত্মক ও কল্পনাপ্রবণ উপস্থাপনার মাধ্যমে তুলে ধরতেন। তাঁর নাটকগুলোতে সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বর ধ্বনিত হতো। তিনি প্রায় ১০০টি একাঙ্ক ও পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘নরক গুলজার’, ‘অশ্বত্থামা’, ‘চাকভাঙা মধু’, ‘মেষ ও রাক্ষস’, ‘গল্প হেকিম সাহেব’, ‘রাজদর্শন’, ‘আলোকানন্দার পুত্র কন্যা’, ‘সাজানো বাগান’, ‘ছায়ার প্রসাদ’, ‘জেনে শুনে বিষ’ ইত্যাদি।
মনোজ মিত্র শুধু নাট্যকার হিসেবেই নয়, অভিনেতা হিসেবেও সমান পারদর্শী ছিলেন। তিনি ৮০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘গণশত্রু’ এবং তপন সিনহার ‘বাঁচারামের বাগান’। ‘বাঁচারামের বাগান’ চলচ্চিত্রটি ছিল তাঁরই নাটক ‘সাজানো বাগান’-এর চলচ্চিত্র রূপান্তর। এই চলচ্চিত্রে তিনি ৯০ বছর বয়সী একজন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, যখন তাঁর নিজের বয়স ছিল মাত্র ৪০ এর কাছাকাছি। এই অভিনয়ের জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারও পেয়েছিলেন।
মনোজ মিত্র শুধু নাটক ও চলচ্চিত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগের অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি শিশিরকুমার ভাদুড়ী অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি ‘সুন্দরম’ নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী পরিচালনা করতেন।
70th National Film Awards 2024: ‘আত্তাম’ সেরা চলচ্চিত্র, ঋষভ শেট্টি সেরা অভিনেতা
মনোজ মিত্রের জীবন ছিল নাটকের মতোই বর্ণময়। তাঁর বাল্যকাল কেটেছে অবিভক্ত বাংলায়। তাঁর পিতা অশোক কুমার মিত্র ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। ছোটবেলায় তিনি বাড়িতে দুর্গাপূজার সময় যে নাটকের আয়োজন হতো, তা দেখার অনুমতি পেতেন না। কিন্তু নাটকের জন্য ব্যবহৃত পর্দা, পোশাক ও অন্যান্য জিনিসপত্র দেখেই তাঁর মধ্যে নাটকের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়।
দেশভাগের পর তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯৫৮ সালে স্নাতক হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কলেজ জীবনেই তিনি নাটকের প্রতি আকৃষ্ট হন। তখন বাদল সরকার, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের মতো পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়ে ওঠা ব্যক্তিরাও কলেজে পড়তেন।
মনোজ মিত্রের প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’ রাজ্যব্যাপী একটি প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পায়। এরপর থেকে তিনি নাটক লেখা, পরিচালনা ও অভিনয় – তিনটি ক্ষেত্রেই সমান দক্ষতার সাথে কাজ করে যান। তাঁর নাটকগুলোতে দেশভাগ, নকশাল আন্দোলন, শাসকশ্রেণীর অত্যাচার, ধর্মীয় মৌলবাদ সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
মনোজ মিত্র তাঁর কর্মজীবনে বহু সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৫), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা নাট্যকার পুরস্কার (১৯৮৬), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেরা নাট্যকার পুরস্কার (১৯৮৩ ও ১৯৮৯), এশিয়াটিক সোসাইটির স্বর্ণপদক (২০০৫), ফিল্মফেয়ার পূর্বাঞ্চল সেরা অভিনেতা পুরস্কার (১৯৮০), বাংলাদেশ থিয়েটার সোসাইটির মুনির চৌধুরী পুরস্কার (২০১১) ইত্যাদি।
মনোজ মিত্রের মৃত্যুতে বাংলা নাট্যজগত ও চলচ্চিত্র শিল্পে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “বিখ্যাত অভিনেতা, পরিচালক ও নাট্যকার, ‘বঙ্গ বিভূষণ’ মনোজ মিত্রের প্রয়াণে আমি গভীরভাবে দুঃখিত। তিনি আমাদের নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতের একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং তাঁর অবদান অপরিসীম। আমি তাঁর পরিবার, বন্ধু ও অনুরাগীদের প্রতি আমার সমবেদনা জানাচ্ছি।”
মনোজ মিত্রের মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা পূরণ করা সহজ নয়। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত শিল্পী, যিনি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ করতেন। তাঁর নাটক ও অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি মানুষের মনে গভীর ছাপ রেখে গেছেন। তাঁর সৃষ্টি আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে থাকবে। মনোজ মিত্রের প্রয়াণে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগত হারালো একজন অকুতোভয় শিল্পীকে, যিনি সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবতার পক্ষে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন।