Soaking lentils health benefits: ভারতীয় রান্নাঘরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হল ডাল। প্রোটিন, ফাইবার এবং খনিজের সমৃদ্ধ উৎস হিসেবে ডাল আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তবে অনেকেই জানেন না যে রান্নার আগে ডাল ভিজিয়ে রাখা শুধু রান্নার সময় কমায় না, বরং এর পুষ্টিগুণও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়। আয়ুর্বেদ থেকে শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞান পর্যন্ত সবাই একমত যে রান্নার আগে ডাল ভিজিয়ে রাখা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। আসুন জেনে নেই কেন এবং কতক্ষণ ডাল ভিজিয়ে রাখা উচিত, আর এর পিছনে থাকা বিজ্ঞানভিত্তিক কারণগুলি কী।
ডাল ভিজিয়ে রাখার প্রধান উপকারিতা
ডাল ভিজিয়ে রাখার অভ্যাস শুধুমাত্র পারম্পরিক প্রথা নয়, বরং এর পিছনে রয়েছে বিজ্ঞানসম্মত কারণ। আসুন জেনে নেই কেন আপনার রান্নার আগে ডাল ভিজিয়ে রাখা উচিত:
উন্নত পুষ্টি শোষণ
ডাল ভিজিয়ে রাখলে ফাইটেজ নামক একটি এনজাইম সক্রিয় হয়, যা ফাইটিক অ্যাসিড ভেঙে ফেলতে সাহায্য করে। ফাইটিক অ্যাসিড হল একটি এন্টি-নিউট্রিয়েন্ট যা ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং জিঙ্ক জাতীয় খনিজের শোষণে বাধা দেয়। ডাল ভিজিয়ে রাখলে এই এন্টি-নিউট্রিয়েন্টস কমে যায় এবং শরীর খনিজগুলি সহজেই শোষণ করতে পারে।
হজমে সহায়তা
ডালে থাকা জটিল শর্করা এবং প্রোটিন ভিজিয়ে রাখার ফলে ভেঙে যায়1। এতে অ্যামাইলেজ নামক একটি যৌগ সক্রিয় হয় যা ডালে থাকা জটিল স্টার্চকে ভেঙে ফেলে এবং হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে। এছাড়া ডালে থাকা লেকটিন ও ট্যানিন, যা হজমে সমস্যা সৃষ্টি করে, সেগুলিও ভিজিয়ে রাখার ফলে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
গ্যাস ও ফোলাভাব কমায়
অনেকেই ডাল খাওয়ার পর পেটে গ্যাস ও ফোলাভাবের সমস্যায় ভোগেন। ডালে থাকা অলিগোস্যাকারাইড নামক জটিল শর্করা এর জন্য দায়ী। ভিজিয়ে রাখার ফলে এই জটিল শর্করার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়, যা গ্যাসের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
রান্নার সময় কমায়
ডাল ভিজিয়ে রাখলে এটি নরম হয়ে যায় এবং রান্নার সময় কম লাগে। এতে শুধু সময়ই বাঁচে না, জ্বালানি ও পানির খরচও কমে যায়6। দ্রুত রান্না হওয়ার কারণে ডালের পুষ্টিগুণও বেশি পরিমাণে সংরক্ষিত থাকে।
কীটনাশক মুক্ত করে
ডাল ভিজিয়ে রাখার ফলে এর বাহ্যিক স্তরে থাকা কীটনাশক দূর হয়। কীটনাশক মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে, তাই ভিজিয়ে রাখার মাধ্যমে আপনি ডালকে নিরাপদ ও পরিষ্কার করে তুলতে পারেন।
স্বাদ ও গঠন উন্নত করে
ডাল ভিজিয়ে রাখলে এর স্বাদ ও গঠন উন্নত হয়। সিদ্ধ করার সময় ভিজানো ডাল সমানভাবে রান্না হয় এবং মসলা ভালোভাবে শোষণ করে, যা খাবারের স্বাদকে আরও সমৃদ্ধ করে।
বিভিন্ন ধরনের ডাল ভিজানোর সঠিক সময়
সব ডাল একই সময় ধরে ভিজিয়ে রাখা উচিত নয়। বিভিন্ন ধরনের ডালের জন্য আলাদা আলাদা সময় প্রয়োজন। আসুন জেনে নেই কোন ডাল কতক্ষণ ভিজিয়ে রাখা উচিত:
শ্রেণী ১: ভাঙা ডাল
হলুদ মুগ ডাল, ছোলার ডাল, মাসকলাই ডাল, অড়হর ডাল – এই ধরনের ভাঙা ডাল রান্না করা সহজ, তাই এগুলি ৪-৬ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা যথেষ্ট। ছোলার ডাল ৬-৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে উত্তম ফল পাওয়া যায়।
শ্রেণী ২: সম্পূর্ণ ডাল
লাল মুগ, সবুজ মুগ, কুলথি – এই ধরনের ছোট ডাল ৬-৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা উচিত8। এগুলি অঙ্কুরিতও করা যায়, যা আরও বেশি পুষ্টিকর।
শ্রেণী ৩: বড় ডাল ও ছোলা
সয়াবিন, রাজমা, কাবুলি ছোলা, কালো বিন – এই বড় ডালগুলি তাদের আকার ও কঠিন গঠনের কারণে ৮-১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা উচিত। রাজমা ও কাবুলি ছোলা জাতীয় ভারী ডাল রাতভর বা ১২-১৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা উচিত।
বিশেষ উল্লেখ:
-
মুগ ডাল: ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা
-
তুর ডাল (অড়হর): ১-২ ঘণ্টা
-
মাসকলাই ডাল: ৪-৬ ঘণ্টা
দ্রুত ভিজানোর কৌশল
যদি আপনার কাছে ডাল ভিজিয়ে রাখার পর্যাপ্ত সময় না থাকে, তবে এখানে কিছু দ্রুত ভিজানোর কৌশল রয়েছে:
ফুটন্ত পানি পদ্ধতি
ডাল ভালোভাবে ধুয়ে নিন। একটি পাত্রে ডাল রাখুন এবং তার উপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দিন যাতে ডাল পুরোপুরি ডুবে যায়। এটিকে প্রায় ৩০ মিনিট রেখে দিন। এই পদ্ধতিতে তুর ডাল বা মুগ ডাল দ্রুত ভিজিয়ে নিতে পারেন।
মাইক্রোওয়েভ পদ্ধতি
ডাল ধুয়ে মাইক্রোওয়েভ-সেফ পাত্রে রাখুন। ডালের উপর ১ ইঞ্চি পানি যোগ করুন। ১০ মিনিট উচ্চ তাপে মাইক্রোওয়েভ করুন, তারপর আরও ১৫-২০ মিনিট গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। এটি দ্রুত ডাল রান্নার জন্য উপযুক্ত।
প্রেশার কুকার ট্রিক
কিছু ডাল যেমন ছোলা ডাল ভিজিয়ে না রেখেও রান্না করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে ধোয়া ডালে এক চিমটি বেকিং সোডা যোগ করে সরাসরি প্রেশার কুকারে রান্না করুন। তবে বেকিং সোডা বেশি পরিমাণে ব্যবহার করবেন না।
ডাল ভিজানোর সঠিক পদ্ধতি
ডাল ভিজানোর একটি সঠিক পদ্ধতি আছে যা অনুসরণ করলে সর্বাধিক উপকার পাওয়া যায়:
-
একটি পাত্রে ডাল নিন এবং পানি দিয়ে ৩-৪ বার ভালোভাবে ধুয়ে নিন।
-
আঙুল দিয়ে হালকাভাবে ঘষে ডালের ধুলো-ময়লা পরিষ্কার করুন।
-
এবার পাত্রে পর্যাপ্ত পানি যোগ করুন। ডালের পরিমাণের তিন গুণ পানি নিলে ভালো হয়।
-
ডালের ধরন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় ভিজিয়ে রাখুন।
-
ভিজানোর সময় পানিতে একটু হলুদ বা লবণ যোগ করতে পারেন, এতে স্বাদ বাড়বে।
আয়ুর্বেদে ডাল ভিজানোর গুরুত্ব
আয়ুর্বেদিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ডাল ভিজিয়ে রাখা শুধুমাত্র পুষ্টিগুণ বাড়ানোর জন্য নয়, বরং এটি ডালে “প্রাণ” বা জীবনীশক্তি যোগ করে। ড. দিক্ষা ভাবসর, একজন আয়ুর্বেদিক বিশেষজ্ঞ, বলেছেন যে ভিজিয়ে রাখার প্রক্রিয়া ডালের নিষ্ক্রিয় ও দুষ্পাচ্য অবস্থা থেকে পুষ্টিতে ভরপুর ও সম্পূর্ণ হজমযোগ্য অবস্থায় পরিবর্তন করে। এটি অ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্টগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে এবং প্রধান হজম এনজাইমগুলির নিঃসরণকে উৎসাহিত করে।
ডাল ভিজিয়ে রাখা একটি সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ যা আপনার রান্না এবং স্বাস্থ্য উভয়ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে। এটি শুধু রান্নার সময় কমায় না, বরং পুষ্টিগুণ বাড়ায়, হজমে সাহায্য করে, গ্যাস ও ফোলাভাব কমায়, কীটনাশক দূর করে এবং স্বাদ উন্নত করে। বিভিন্ন ধরনের ডালের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সময় প্রয়োজন, তাই আপনার রান্নার পরিকল্পনা অনুযায়ী সঠিক ভিজানোর সময় নির্বাচন করুন।
যদি আপনার ডাল ভিজিয়ে রাখার অভ্যাস না থাকে, তবে আজ থেকেই শুরু করুন। এই ছোট্ট পরিবর্তন আপনার খাবারের স্বাদ এবং স্বাস্থ্যগত উপকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেবে। মনে রাখবেন, ডাল এমনিতেই স্বাস্থ্যকর খাবার, কিন্তু সঠিকভাবে ভিজিয়ে রান্না করলে এর পুষ্টিগুণ আরও বেড়ে যায়6। আপনার পরিবারের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য এই সহজ অভ্যাসটি গ্রহণ করতে দ্বিধা করবেন না।