Teeth tingle aluminum foil: আমরা অনেকেই হয়তো কোনো এক সময় এই অদ্ভুত, অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। হয়তো চুইংগামের র্যাপার বা স্যান্ডউইচে লেগে থাকা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের একটি ক্ষুদ্র টুকরো ভুলবশত কামড়ে ফেলার সাথে সাথেই দাঁতের মধ্যে একটা তীব্র, বৈদ্যুতিক শকের মতো শিরশিরানি অনুভব করেছি। এই আকস্মিক এবং তীব্র অনুভূতিটি বেশ বিরক্তিকর এবং এটি আমাদের ভাবায় যে ঠিক কী ঘটল। এর পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণটি হলো ‘গ্যালভানিক শক’ (Galvanic Shock) বা গ্যালভানিক কারেন্ট। যখন অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল (একটি ধাতু) আপনার মুখের লালার (যা একটি ইলেক্ট্রোলাইট) উপস্থিতিতে আপনার দাঁতের মেটাল ফিলিং (অন্য একটি ধাতু, সাধারণত অ্যামালগাম) স্পর্শ করে, তখন এটি আক্ষরিক অর্থেই আপনার মুখের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক ব্যাটারি তৈরি করে। এই ব্যাটারি থেকে উৎপন্ন বৈদ্যুতিক প্রবাহ আপনার দাঁতের স্নায়ুকে (nerve) সরাসরি উদ্দীপিত করে, যার ফলে আপনি সেই তীব্র, ক্ষণস্থায়ী শিরশিরানি বা ব্যথা অনুভব করেন। এটি কোনো কাল্পনিক অনুভূতি নয়, বরং এটি একটি বাস্তব ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল প্রতিক্রিয়া।
এই ঘটনাটি বোঝার জন্য, আমাদের রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানের কিছু মৌলিক বিষয় জানতে হবে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি তখনই ঘটে যখন নির্দিষ্ট কিছু উপাদান একত্রিত হয়: দুটি ভিন্ন ধরনের ধাতু এবং একটি পরিবাহী দ্রবণ। আমাদের মুখের মধ্যে, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল এবং দাঁতের অ্যামালগাম ফিলিং হলো সেই দুটি ভিন্ন ধাতু, এবং আমাদের লালা বা স্যালাইভা হলো সেই পরিবাহী দ্রবণ বা ইলেক্ট্রোলাইট। আমেরিকান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন (ADA) অনুসারে, অ্যামালগাম ফিলিং প্রায়শই পারদ, রৌপ্য, টিন এবং তামা-এর মিশ্রণ। যখন অ্যালুমিনিয়ামের মতো একটি বেশি বিক্রিয়াশীল ধাতু, অ্যামালগামের মতো একটি কম বিক্রিয়াশীল ধাতুর সংস্পর্শে আসে একটি ইলেক্ট্রোলাইট দ্রবণে (লালা), তখন ইলেকট্রন প্রবাহ শুরু হয়, যা একটি বৈদ্যুতিক কারেন্ট তৈরি করে। এই নিবন্ধে, আমরা এই ‘গ্যালভানিক শক’-এর বিজ্ঞানকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করব, কেন এটি ঘটে, এর পেছনে দাঁতের গঠন কীভাবে দায়ী, এবং এটি ক্ষতিকারক কিনা তা নিয়ে আলোচনা করব।
এই অদ্ভুত শিরশিরানির পেছনের বিজ্ঞান
যখনই আমরা ‘শক’ শব্দটি শুনি, আমরা বিদ্যুৎ নিয়ে চিন্তা করি। আর ঠিক তাই ঘটছে আপনার মুখে। এই ঘটনাটিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় গ্যালভানিক শক (Galvanic Shock) বা গ্যালভানিজম (Galvanism)। ইতালীয় বিজ্ঞানী লুইগি গ্যালভানির নামে এর নামকরণ করা হয়েছে, যিনি প্রথম আবিষ্কার করেন যে দুটি ভিন্ন ধাতুর মাধ্যমে একটি স্নায়ুকে উদ্দীপিত করা যায়।
গ্যালভানিক শক (Galvanic Shock) আসলে কী?
সহজ কথায়, গ্যালভানিক শক হলো একটি বৈদ্যুতিক প্রবাহ যা দুটি ভিন্ন ধাতু একে অপরের সংস্পর্শে এলে (বা একটি পরিবাহীর মাধ্যমে সংযুক্ত হলে) একটি ইলেক্ট্রোলাইট দ্রবণের মধ্যে তৈরি হয়। এটি একটি সাধারণ ভোল্টাইক সেল (Voltaic Cell) বা ব্যাটারির মূল নীতি।
একটি ব্যাটারি কাজ করার জন্য তিনটি জিনিসের প্রয়োজন:
১. অ্যানোড (Anode): একটি নেতিবাচক ইলেকট্রোড (বেশি বিক্রিয়াশীল ধাতু) যা ইলেকট্রন ত্যাগ করে (জারণ ঘটে)।
২. ক্যাথোড (Cathode): একটি পজিটিভ ইলেকট্রোড (কম বিক্রিয়াশীল ধাতু) যা ইলেকট্রন গ্রহণ করে (বিজারণ ঘটে)।
৩. ইলেক্ট্রোলাইট (Electrolyte): একটি পরিবাহী দ্রবণ (যেমন লবণাক্ত জল) যা আয়নগুলোকে দুই ইলেকট্রোডের মধ্যে চলাচল করতে সাহায্য করে, সার্কিটটি সম্পূর্ণ করে।
যখন আপনি অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল কামড়ান, তখন আপনার মুখ একটি জৈব ব্যাটারিতে পরিণত হয়:
- অ্যানোড: অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল (Aluminum – Al)। অ্যালুমিনিয়াম একটি অত্যন্ত বিক্রিয়াশীল ধাতু এবং এটি সহজেই ইলেকট্রন ত্যাগ করতে চায়।
- ক্যাথোড: আপনার দাঁতের অ্যামালগাম ফিলিং (Amalgam filling)। অ্যামালগাম, যাতে রূপা, টিন, এবং পারদ থাকে, তা অ্যালুমিনিয়ামের চেয়ে অনেক কম বিক্রিয়াশীল।
- ইলেক্ট্রোলাইট: আপনার লালা (Saliva)। লালাতে লবণ (সোডিয়াম ক্লোরাইড) এবং অন্যান্য খনিজ আয়ন দ্রবীভূত থাকে, যা এটিকে একটি চমৎকার বিদ্যুৎ পরিবাহী করে তোলে।
যখন ফয়েলটি আপনার ফিলিংকে স্পর্শ করে (বা খুব কাছাকাছি আসে), তখন লালার মাধ্যমে একটি সার্কিট সম্পূর্ণ হয়। অ্যালুমিনিয়াম থেকে ইলেকট্রন প্রবাহিত হয়ে লালার মধ্য দিয়ে অ্যামালগাম ফিলিং-এ চলে যায়। এই ইলেকট্রনের প্রবাহই হলো বৈদ্যুতিক কারেন্ট। সায়েন্টিফিক আমেরিকান (Scientific American) এর মতো প্রকাশনাগুলো এই ঘটনাটিকে একটি ক্লাসিক “মুখের ব্যাটারি” (mouth battery) উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই ক্ষুদ্র, কিন্তু আকস্মিক বৈদ্যুতিক প্রবাহ যখন আপনার দাঁতের অত্যন্ত সংবেদনশীল স্নায়ুতে আঘাত করে, তখনই আপনি সেই তীব্র শিরশিরানি অনুভব করেন।
মুখের ভিতরের ‘ব্যাটারি’-এর উপাদানসমূহ
এই গ্যালভানিক শক অনুভব করার জন্য, তিনটি প্রধান উপাদানকে সঠিকভাবে একত্রিত হতে হবে। আসুন প্রতিটি উপাদানের ভূমিকা আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি।
প্রথম উপাদান: অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল (অ্যানোড)
অ্যালুমিনিয়াম (Al) হলো পর্যায় সারণীর ১৩ নম্বর গ্রুপের একটি ধাতু। এটি হালকা, নমনীয় এবং তুলনামূলকভাবে সস্তা, যার কারণে এটি প্যাকেজিং, বিশেষত খাদ্য সংরক্ষণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য হলো এর উচ্চ বিক্রিয়াশীলতা। অ্যালুমিনিয়াম খুব সহজেই জারিত (oxidized) হতে চায়, অর্থাৎ এটি তার বাইরের স্তরের তিনটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে $Al^{3+}$ আয়নে পরিণত হতে চায়।
ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল সিরিজে (Electrochemical Series), যা বিভিন্ন পদার্থের ইলেকট্রন ত্যাগ করার প্রবণতা পরিমাপ করে, অ্যালুমিনিয়ামের একটি অত্যন্ত নেতিবাচক স্ট্যান্ডার্ড রিডাকশন পটেনশিয়াল (standard reduction potential) রয়েছে (প্রায় -১.৬৬ ভোল্ট)। এর মানে হলো এটি অন্যান্য অনেক ধাতুর তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়ভাবে ইলেকট্রন দান করবে। যখন এটি আপনার মুখের লালার মতো একটি অ্যাসিডিক বা লবণাক্ত পরিবেশে আসে, তখন এটি জারিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। এই কারণেই এটি গ্যালভানিক সেলে অ্যানোড বা নেতিবাচক টার্মিনাল হিসাবে কাজ করে।
দ্বিতীয় উপাদান: দাঁতের মেটাল ফিলিং (ক্যাথোড)
গ্যালভানিক শকের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো দাঁতের মেটাল ফিলিং, যা সাধারণত ‘সিলভার ফিলিং’ নামে পরিচিত, তবে এর সঠিক নাম ডেন্টাল অ্যামালগাম (Dental Amalgam)।
অ্যামালগাম ফিলিং কী?
ডেন্টাল অ্যামালগাম কোনো একক ধাতু নয়, এটি একটি সংকর ধাতু (alloy)। ইউ.এস. ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) এর মতে, অ্যামালগামে প্রায় ৫০% মৌলিক পারদ (mercury) থাকে। বাকি ৫০% হলো অন্যান্য ধাতুর গুঁড়োর মিশ্রণ, যার মধ্যে প্রধানত থাকে রৌপ্য (silver), টিন (tin) এবং তামা (copper)। এই ধাতব মিশ্রণটি পারদের সাথে মিশে একটি শক্ত, টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী ফিলিং উপাদান তৈরি করে যা শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে দন্তচিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
কেন অ্যামালগাম সমস্যা তৈরি করে?
অ্যামালগামের মধ্যে থাকা ধাতুগুলো (বিশেষত রূপা এবং তামা) অ্যালুমিনিয়ামের তুলনায় অনেক কম বিক্রিয়াশীল। এদের রিডাকশন পটেনশিয়াল অ্যালুমিনিয়ামের চেয়ে অনেক বেশি পজিটিভ। এই বৈদ্যুতিক পটেনশিয়ালের বিশাল পার্থক্যই (potential difference) গ্যালভানিক শকের মূল চালিকাশক্তি। যখন অ্যালুমিনিয়াম (শক্তিশালী অ্যানোড) এবং অ্যামালগাম (শক্তিশালী ক্যাথোড) লালার মাধ্যমে সংযুক্ত হয়, তখন একটি উল্লেখযোগ্য ভোল্টেজ তৈরি হয়, যা একটি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক প্রবাহ সৃষ্টি করে।
অন্যান্য ফিলিং থাকলে কী হবে?
যদি আপনার দাঁতে আধুনিক কম্পোজিট রেসিন (Composite Resin – যা প্লাস্টিক এবং সিরামিকের মিশ্রণ), পোরসেলিন (Porcelain) বা সিরামিক (Ceramic) ফিলিং থাকে, তবে আপনি এই শক অনুভব করবেন না। কারণ এই উপাদানগুলো বিদ্যুৎ অপরিবাহী (non-conductive)। যদি আপনার গোল্ড (Gold) ফিলিং থাকে, যা একটি ধাতু, তাহলেও এই শক অনুভব করার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ যদিও গোল্ড একটি পরিবাহী, এটি একটি ‘নোবল মেটাল’ বা মহৎ ধাতু এবং অ্যামালগামের চেয়েও কম বিক্রিয়াশীল। অ্যালুমিনিয়াম এবং গোল্ডের মধ্যে পটেনশিয়াল পার্থক্য থাকলেও, সাধারণত গোল্ড ফিলিংগুলো একটি মসৃণ পৃষ্ঠতল তৈরি করে যা অ্যামালগামের মতো বিক্রিয়ায় সহজে অংশ নেয় না।
তৃতীয় উপাদান: লালা (Saliva) – একটি শক্তিশালী ইলেক্ট্রোলাইট
তৃতীয় এবং চূড়ান্ত উপাদানটি হলো আমাদের মুখের লালা (Saliva)। বিশুদ্ধ জল খুব ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী নয়। কিন্তু আমাদের লালা বিশুদ্ধ জল নয়। এটি একটি জটিল জৈব তরল যাতে বিভিন্ন লবণ (salts), প্রোটিন এবং এনজাইম দ্রবীভূত থাকে।
বিশেষ করে, লালাতে সোডিয়াম ($Na^+$), পটাসিয়াম ($K^+$), এবং ক্লোরাইড ($Cl^-$) এর মতো আয়ন থাকে। এই দ্রবীভূত আয়নগুলোই লালাকে একটি চমৎকার ইলেক্ট্রোলাইটে পরিণত করে। ইলেক্ট্রোলাইটের কাজ হলো অ্যানোড (অ্যালুমিনিয়াম) থেকে ক্যাথোডে (অ্যামালগাম ফিলিং) ইলেকট্রন প্রবাহের সময় সার্কিটটি সম্পূর্ণ করার জন্য আয়ন পরিবহন করা। যখন অ্যালুমিনিয়াম ইলেকট্রন ($e^-$) ত্যাগ করে $Al^{3+}$ আয়নে পরিণত হয়, তখন লালার মধ্যে থাকা নেতিবাচক আয়নগুলি (যেমন $Cl^-$) সেই দিকে ছুটে যায় এবং লালার মধ্য দিয়ে একটি পথ তৈরি করে যাতে ইলেকট্রনগুলো অ্যামালগাম ফিলিং পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। লালার এই পরিবাহী ক্ষমতা ছাড়া, বৈদ্যুতিক সার্কিটটি সম্পূর্ণ হবে না এবং কোনো শক অনুভূত হবে না।
কীভাবে এই বৈদ্যুতিক প্রবাহ ব্যথা তৈরি করে?
আমরা বুঝলাম যে মুখে একটি ব্যাটারি তৈরি হয় এবং কারেন্ট প্রবাহিত হয়। কিন্তু সেই কারেন্ট কীভাবে আমাদের দাঁতে এত তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে? এর উত্তরটি আমাদের দাঁতের অভ্যন্তরীণ গঠনের মধ্যে নিহিত।
দাঁতের গঠন এবং সংবেদনশীলতা
একটি দাঁত কেবল একটি কঠিন হাড়ের টুকরো নয়। এর বিভিন্ন স্তর রয়েছে:
১. এনামেল (Enamel): এটি দাঁতের সবচেয়ে বাইরের, শক্ত আবরণ। এটি মানবদেহের সবচেয়ে কঠিন পদার্থ। এনামেল প্রায় সম্পূর্ণ খনিজ দিয়ে তৈরি এবং এতে কোনো জীবন্ত কোষ বা স্নায়ু নেই। তাই এনামেল নিজে কোনো ব্যথা অনুভব করতে পারে না।
২. ডেন্টিন (Dentin): এনামেলের ঠিক নিচের স্তরটি হলো ডেন্টিন। এটি হাড়ের মতো শক্ত হলেও, এটি জীবন্ত টিস্যু। ডেন্টিনের মধ্যে হাজার হাজার ক্ষুদ্র, আণুবীক্ষণিক নল (microscopic tubules) থাকে, যাকে ‘ডেন্টিনাল টিউবিউলস’ (Dentinal Tubules) বলা হয়। এই নলগুলো দাঁতের কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে প্রসারিত থাকে এবং এর মধ্যে তরল পদার্থ ও স্নায়ুর ক্ষুদ্র শাখা থাকে।
৩. পাল্প (Pulp): এটি দাঁতের একেবারে কেন্দ্রে থাকা নরম, জীবন্ত অংশ। পাল্প চেম্বারের মধ্যে রয়েছে রক্তনালী (blood vessels) এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, দাঁতের প্রধান স্নায়ু (nerve)। এই স্নায়ু অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং এটিই আমাদের ঠান্ডা, গরম বা চাপের অনুভূতি মস্তিষ্কে পাঠায়।
স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া (The Neural Response)
যখন একজন ডেন্টিস্ট আপনার দাঁতে ক্যাভিটির জন্য ফিলিং করেন, তখন সেই ফিলিংটি সাধারণত এনামেল ভেদ করে ডেন্টিনের মধ্যে বা খুব কাছাকাছি স্থাপন করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে, গভীর ফিলিং পাল্পের খুব কাছে চলে যেতে পারে।
যখন গ্যালভানিক শক তৈরি হয়, তখন বৈদ্যুতিক কারেন্টটি পরিবাহী অ্যামালগাম ফিলিং-এর মাধ্যমে সরাসরি সংবেদনশীল ডেন্টিনে চলে যায়। এই বিদ্যুৎ প্রবাহ ডেন্টিনাল টিউবিউলসের মধ্যে থাকা তরলকে আলোড়িত করে এবং সরাসরি পাল্পে থাকা স্নায়ু প্রান্তগুলোকে (nerve endings) উদ্দীপিত করে।
আমাদের স্নায়ুতন্ত্র নিজেই বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে কাজ করে। মস্তিষ্ক থেকে পেশীতে সংকেত পাঠানো বা ত্বক থেকে মস্তিষ্কে স্পর্শের অনুভূতি পাঠানো—এ সবই ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক ইমপালস। তাই যখন বাইরে থেকে একটি অপ্রত্যাশিত, অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বৈদ্যুতিক প্রবাহ (যা গ্যালভানিক শক থেকে আসে) সরাসরি দাঁতের স্নায়ুতে আঘাত করে, তখন স্নায়ু কোষগুলো অতিরিক্ত উদ্দীপিত (over-stimulated) হয়ে পড়ে। মস্তিষ্ক এই আকস্মিক এবং তীব্র সংকেতকে বিপদ সংকেত হিসেবে ব্যাখ্যা করে, যার ফলে আমরা একটি ধারালো, বৈদ্যুতিক শকের মতো ব্যথা অনুভব করি। এটি সাধারণ দাঁতের ব্যথার চেয়ে আলাদা, কারণ এটি রাসায়নিক বা যান্ত্রিক নয়, বরং সরাসরি বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা।
এই গ্যালভানিক শক কি ক্ষতিকর?
এই অভিজ্ঞতাটি অত্যন্ত অস্বস্তিকর এবং যন্ত্রণাদায়ক হলেও, সুখবর হলো এটি সাধারণত ক্ষতিকারক নয়।
একটি যন্ত্রণাদায়ক কিন্তু নিরীহ ঘটনা
গ্যালভানিক শক দ্বারা উৎপন্ন বৈদ্যুতিক কারেন্টের পরিমাণ খুবই কম (সাধারণত মাইক্রোঅ্যাম্পিয়ার রেঞ্জে) এবং এটি অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। আপনি ফয়েলটি মুখ থেকে সরিয়ে ফেলার সাথে সাথেই সার্কিটটি ভেঙে যায় এবং ব্যথা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। হেলথলাইন (Healthline)-এর মতো স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইটগুলো নিশ্চিত করে যে এই ঘটনাটি দাঁত বা ফিলিং-এর কোনো স্থায়ী ক্ষতি করে না, অথবা এটি কোনো দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে না। এটি কেবল রসায়নের একটি দুর্ভাগ্যজনক কিন্তু আকর্ষণীয় প্রদর্শনী।
তবে, এখানে ডেন্টাল অ্যামালগামের নিরাপত্তা নিয়ে একটি বিস্তৃত আলোচনা প্রাসঙ্গিক। অ্যামালগামে পারদ থাকার কারণে বছরের পর বছর ধরে এর নিরাপত্তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। পারদ একটি পরিচিত নিউরোটক্সিন। কিন্তু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং এফডিএ (FDA)-এর মতো সংস্থাগুলো জানিয়েছে যে অ্যামালগাম ফিলিং-এ পারদ অন্যান্য ধাতুর সাথে আবদ্ধ (bound) থাকে, যা এটিকে স্থিতিশীল করে এবং শরীর দ্বারা শোষিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কমিয়ে দেয়। তাদের মতে, সাধারণ মানুষের জন্য অ্যামালগাম ফিলিং নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়, যদিও পারদ অ্যালার্জিযুক্ত ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট কিছু ঝুঁকির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকতে পারে। গ্যালভানিক শক অ্যামালগাম থেকে পারদ নিঃসরণের কারণ হয় না; এটি কেবল একটি পৃষ্ঠতলীয় বৈদ্যুতিক ঘটনা।
বারবার ঘটলে কী করণীয়?
যদিও ফয়েল কামড়ানোর ঘটনাটি নিরীহ, তবে আপনি যদি ফয়েল ছাড়াই (যেমন, একটি ধাতব চামচ বা কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়ার সময়) মাঝে মাঝে এই ধরনের শক অনুভব করেন, তবে এটি একটি ভিন্ন সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। এটি ঘটতে পারে যদি আপনার মুখে দুটি ভিন্ন ধাতুর ফিলিং (যেমন একটি গোল্ড ক্রাউন এবং একটি অ্যামালগাম ফিলিং) একে অপরের খুব কাছাকাছি থাকে এবং স্পর্শ করে। এটি একটি ক্ষতিগ্রস্ত বা ভাঙা ফিলিং-এর লক্ষণও হতে পারে। যদি এটি ঘন ঘন ঘটে, তবে একজন ডেন্টিস্টের সাথে পরামর্শ করা ভালো, যাতে তিনি পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে পারেন।
কেন সবাই এই অভিজ্ঞতা পান না?
এটি একটি সাধারণ প্রশ্ন। অনেকেই হয়তো ফয়েল কামড়েছেন কিন্তু কিছুই অনুভব করেননি। এর পেছনে কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ রয়েছে:
১. ফিলিং-এর ধরন (Type of Filling): এটি সবচেয়ে বড় কারণ। যেমনটি আগে উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের দাঁতে কম্পোজিট রেসিন, সিরামিক বা পোরসেলিন ফিলিং আছে, তারা এই শক অনুভব করবেন না কারণ এই উপাদানগুলো বিদ্যুৎ অপরিবাহী। বিশ্বব্যাপী আধুনিক দন্তচিকিৎসায় নান্দনিক কারণে এবং পারদের উদ্বেগ এড়াতে অ্যামালগামের পরিবর্তে এই কম্পোজিট ফিলিং-এর ব্যবহার বাড়ছে।
২. অ্যামালগাম ফিলিং-এর বয়স (Age of the Amalgam Filling): যাদের অ্যামালগাম ফিলিং আছে, তারাও সবসময় এটি অনুভব নাও করতে পারেন। সময়ের সাথে সাথে, অ্যামালগাম ফিলিং-এর পৃষ্ঠে একটি অক্সাইড স্তর (oxide layer) বা কলঙ্ক (tarnish) তৈরি হয়। লালা এবং খাবারের সংস্পর্শে এসে এই রাসায়নিক স্তরটি তৈরি হয়। এই অক্সাইড স্তরটি একটি অন্তরক (insulator) হিসাবে কাজ করতে পারে, যা গ্যালভানিক কারেন্ট তৈরি হতে বাধা দেয় বা তাকে দুর্বল করে দেয়। এই কারণেই নতুন অ্যামালগাম ফিলিং যাদের আছে, তাদের এই শক অনুভব করার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৩. সংযোগের অভাব (Lack of Contact): শকটি অনুভব করার জন্য, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলটিকে সরাসরি ফিলিংটিকে স্পর্শ করতে হবে বা লালার মাধ্যমে খুব ঘনিষ্ঠ বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপন করতে হবে। যদি ফয়েলটি দাঁতের অন্য অংশকে স্পর্শ করে বা ফিলিং থেকে দূরে থাকে, তবে কোনো সার্কিট তৈরি হবে না।
৪. ব্যক্তিগত সংবেদনশীলতা (Personal Sensitivity): প্রতিটি মানুষের ব্যথার প্রতি সহনশীলতা এবং স্নায়বিক সংবেদনশীলতা ভিন্ন। কিছু মানুষের দাঁতের স্নায়ু অন্যদের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল হতে পারে, যার ফলে তারা খুব সামান্য বৈদ্যুতিক প্রবাহেও তীব্র প্রতিক্রিয়া অনুভব করেন।
আধুনিক দন্তচিকিৎসা এবং প্রতিরোধ
যদিও গ্যালভানিক শক ক্ষতিকারক নয়, তবুও এটি এড়িয়ে চলাই ভালো।
সহজ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
সবচেয়ে সহজ এবং সুস্পষ্ট প্রতিরোধ হলো অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল চিবানো এড়িয়ে চলা। চুইংগাম, চকলেট বা স্যান্ডউইচ খাওয়ার আগে সতর্ক থাকুন যাতে কোনো ফয়েল র্যাপার মুখে না যায়। যেহেতু এটি একটি বিরল ঘটনা, তাই এর জন্য বিশেষ কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
অ্যামালগাম-এর বিকল্প (Alternatives to Amalgam)
আপনি যদি এই সংবেদন সম্পর্কে খুব চিন্তিত হন বা আপনার পুরানো অ্যামালগাম ফিলিং পরিবর্তন করতে চান, তবে আধুনিক দন্তচিকিৎসায় অনেক চমৎকার এবং অ-পরিবাহী (non-conductive) বিকল্প উপলব্ধ রয়েছে:
| ফিলিং-এর ধরন | উপাদান | সুবিধা | অসুবিধা |
| অ্যামালগাম | পারদ, রূপা, টিন, তামা | অত্যন্ত টেকসই, দীর্ঘস্থায়ী, সস্তা। | রূপালী রঙ (নান্দনিক নয়), গ্যালভানিক শকের সম্ভাবনা, পারদ নিয়ে উদ্বেগ। |
| কম্পোজিট রেসিন | প্লাস্টিক এবং সিরামিকের মিশ্রণ | দাঁতের রঙের (নান্দনিক), সরাসরি দাঁতের সাথে বন্ধন তৈরি করে। | অ্যামালগামের চেয়ে কম টেকসই (বিশেষত বড় ফিলিং-এ), কফি বা চায়ের দাগ পড়তে পারে। |
| পোরসেলিন/সিরামিক | সিরামিক উপাদান | অত্যন্ত নান্দনিক (দাঁতের মতো দেখতে), দাগ-প্রতিরোধী, টেকসই। | কম্পোজিটের চেয়ে ব্যয়বহুল, ভঙ্গুর হতে পারে, সাধারণত ল্যাবে তৈরি করতে হয় (ইনলে/অনলে)। |
| গোল্ড (সোনা) | সোনার সংকর ধাতু | অত্যন্ত টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী, বায়ো-কম্প্যাটিবল (শরীরের জন্য সহনশীল)। | অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সোনালী রঙ (নান্দনিকভাবে সবার পছন্দ নয়)। |
আপনার যদি নতুন ফিলিং-এর প্রয়োজন হয় বা পুরানো ফিলিং প্রতিস্থাপন করার কথা ভাবেন, তবে আপনার ডেন্টিস্টের সাথে এই বিকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত। তিনি আপনার দাঁতের অবস্থান, ক্যাভিটির আকার এবং আপনার বাজেট বিবেচনা করে সেরা বিকল্পটির পরামর্শ দিতে পারবেন।
শেষ পর্যন্ত, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল কামড়ালে দাঁতে যে তীব্র শিরশিরানি অনুভূত হয়, তা কোনো রহস্যময় ঘটনা বা গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকির লক্ষণ নয়। এটি আপনার মুখের মধ্যে ঘটে যাওয়া প্রাথমিক রসায়ন এবং পদার্থবিজ্ঞানের একটি নিখুঁত উদাহরণ। এটি একটি ক্ষণস্থায়ী ‘গ্যালভানিক শক’, যা তখন ঘটে যখন অ্যালুমিনিয়ামের মতো একটি বিক্রিয়াশীল ধাতু, লালার মতো একটি ইলেক্ট্রোলাইটের উপস্থিতিতে, অ্যামালগাম ফিলিং-এর মতো একটি কম বিক্রিয়াশীল ধাতুকে স্পর্শ করে একটি ক্ষুদ্র ব্যাটারি তৈরি করে। এই ব্যাটারি থেকে উৎপন্ন বৈদ্যুতিক প্রবাহ সরাসরি আপনার দাঁতের সংবেদনশীল স্নায়ুকে উদ্দীপিত করে, যার ফলে সেই বৈদ্যুতিক শকের অনুভূতি হয়।
যদিও এই অভিজ্ঞতাটি যন্ত্রণাদায়ক, এটি সম্পূর্ণ নিরীহ এবং ক্ষণস্থায়ী। আধুনিক দন্তচিকিৎসায় কম্পোজিট বা সিরামিক ফিলিং-এর মতো অ-পরিবাহী বিকল্পের ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে এই অদ্ভুত ঘটনাটিও ধীরে ধীরে বিরল হয়ে উঠছে। তাই পরের বার যদি ভুলবশত এমনটা ঘটেও যায়, আপনি অন্তত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটি জেনে স্বস্তি পেতে পারেন যে, এটি কেবল বিজ্ঞানের একটি ছোট্ট, চমকপ্রদ খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।











